রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে

রাশিয়া ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হয় গমসহ বিভিন্ন পণ্য

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ইউরোপে দুটি দেশের মধ্যে গতকাল যে যুদ্ধটি শুরু হয়েছে সেটি বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে। তারপরও রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধের আঁচ পড়তে পারে বাংলাদেশে। দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। আর জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে বাড়তে পারে শিল্পসহ নিত্যপণ্যের দামও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে গম রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে রয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাম। আর ইউরোপে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহের মূল উৎস্যস্থল হচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হতেই এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এটি শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগাম (ইউএনডিপি)-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো ধরনের যুদ্ধে যেহেতু বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যে প্রভাব পড়ে, বাংলাদেশেও পড়বে। তবে পণ্যমূল্যের প্রভাব নির্ভর করবে চলমান যুদ্ধের মেয়াদ ও সরকারি উদ্যোগের ওপর। যদি এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে হয়, তবে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিয়ে সরকারের উচিত হবে এর দাম সহনীয় রাখা। এটি না হলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, পণ্যের দামেও প্রভাব পড়বে।

খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশ কোনো পার্টি না হলেও এর প্রভাব থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয়। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশে গম আমদানিতে খরচ বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে আটার দামের ওপর। ফলে দেশের বাজারে এমনিতেই বাড়তে থাকা খাদ্যপণ্যের দাম নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।

সরকারি তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন ছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন, বর্তমানে সেটি কমে ১২-১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে। অপরদিকে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে গমের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে গমের বার্ষিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির চাহিদার বেশির ভাগই আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। গত অর্থবছরে প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১২ লাখ টনের কিছু বেশি। এ ছাড়া সরকারি পর্যায়ে আরও প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন আমদানি বাদ দিলে, বাকি ৫৮ লাখ মেট্রিক টনের পুরোটাই আমদানি হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। আর বেসরকারি খাতের এই আমদানির বেশির ভাগই আসে রাশিয়া-ইউক্রেন, আর্জেন্টিনা ও ভারত থেকে। খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বলে কথা নয়, যে কোনো দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে সামগ্রিক বিশ্বেই তার প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশও এর বাইরে না। তবে চলতি অর্থবছর অর্থাৎ আগামী জুন পর্যন্ত আমাদের গম আমদানির যে টার্গেট ছিল সেটি প্রায় পূরণ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ গমের তুলনায় চালের ওপর বেশি নির্ভরশীল। গত কয়েক বছর ধরে চাল উৎপাদনও হচ্ছে বেশি। ফলে এ মৌসুমে খাদ্য নিয়ে আমাদের তেমন চিন্তা নেই।

তবে সরকারিভাবে গম আমদানিতে সমস্যা না হলেও বেসরকারি খাতে কিছু সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাদ্য সচিব। তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম রপ্তানি কমে গেলে, আমদানিকারক দেশগুলো তখন আর্জেন্টিনা, ভারত থেকে আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা করবে। ফলে ওই দেশগুলো তখন দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুদ্ধের আঁচ পেয়েই রপ্তানিকারক দেশগুলো গমের দাম বাড়াতে শুরু করে। গত কয়েকদিনে পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৭০-৮০ টাকা। ভারত থেকে আমদানি হওয়া গম গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১০৫ টাকায়। কয়েক সপ্তাহ আগেও একই মানের গম বিক্রি হতো ১ হাজার ২৫ থেকে ১ হাজার ৩৫ টাকায়। এ ছাড়া এ সময়ে কানাডা থেকে আমদানি হওয়া গমের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেও দাম বাড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে এরই মধ্যে তেলের দাম বাড়ছে। দুই দেশের মধ্যে এই যুদ্ধ হলেও এর সঙ্গে যেহেতু প্রভাবশালী আরও কয়েকটি দেশের পাওয়ার গেম জড়িত, ফলে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে-এমন ধরনের একটি প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। সেই প্রত্যাশা থেকেও অনেক সময় দাম বেড়ে যায়। তবে রাশিয়া অনেক বড় দেশ। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তিতে যাচ্ছে। ফলে দেশটি চাইবে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোতে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। সে কারণে আমি মনে করি, এই যুদ্ধে পণ্যের দাম বাড়লেও পণ্যের সরবরাহ কমবে না।

সর্বশেষ খবর