মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ধীরগতি মানব পাচার মামলার বিচারে

সাক্ষী না পাওয়াকে দায়ী করলেন সংশ্লিষ্টরা, বিচারাধীন সাড়ে ৬ হাজার, নিষ্পত্তি মাত্র ৮১২টি

মাহবুব মমতাজী

ধীরগতি মানব পাচার মামলার বিচারে

কক্সবাজারের রামু উপজেলার ১৫ বছর বয়সী কিশোরীকে নেপালে ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়েছিল মানব পাচারকারীরা। ২০১৪ সালের আগস্টে তাদের খপ্পরে পড়ে ওই কিশোরীর ঠাঁই হয় খুলনার একটি যৌনপল্লীতে। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পাঁচ মাস পর ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে রামু থানায় মামলা করে কিশোরীর পরিবার।

ওই বছরের অক্টোবরে তিনজনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ। এখন পর্যন্ত বিচার দূরে থাক, আসামিদের কেউ ধরা পড়েননি। এটির মতো সারা দেশে ৬ হাজার ৩৬৭টি মানব পাচার মামলার বিচারকাজ এখনো চলমান। এ ছাড়া বিচার সম্পন্ন হয়েছে ৮১২টি মামলার। এ ছাড়াও কক্সবাজারের ৪৬৭টি মামলারও বিচার চলমান আছে। বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মানব পাচারকারী ও দালালরা। আর পাচারের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো রয়েছে দুর্বিষহ যন্ত্রণায়। আইনজীবীরা বলছেন, সাক্ষীর অভাবে থেমে রয়েছে মামলার বিচার কার্যক্রম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ৮টি রুট ব্যবহার করে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষদের পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, সাতক্ষীরার দেবহাটা, যশোরের বেনাপোল,  লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও দহগ্রাম, জয়পুরহাটের বস্তাকর, মৌলভীবাজারের পশ্চিম শিলুয়া, কক্সবাজার টেকনাফের জালিয়াপাড়া এবং কুমিল্লার গোলাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে পাচারের ঘটনা ঘটে। ছোট ছোট রুটের মধ্যে আছে বান্দরবানের সীমান্ত এলাকা, সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

রামু থানায় ২০১৫ সালের মামলাটির বিষয়ে ওই কিশোরীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল হক জানান, ওই মামলাটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। মামলাটি এখনো সাক্ষী পর্যায়ে আছে। দীর্ঘদিন মামলাটি বিচারাধীন থাকায় ভুক্তভোগীরা হতাশ হয়ে আর মামলার খোঁজ রাখেন না। মামলার সাক্ষীদেরও পাওয়া যায় না। পরে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। সে খুবই অসহায়। বাবা নেই, শুধু মা বেঁচে আছেন।

পুলিশ সদর দফতরের সারা দেশের মানব পাচার মামলার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ জুন থেকে গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ১৭৯টি মামলা হয়েছে। এর ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৮০৭ জন। এদের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ১০ হাজার ৮৮ জনকে। এদেরকে পাচারে সম্পৃক্ততায় ২৯ হাজার ৫৩০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর গ্রেফতার করা হয়েছে ১৩ হাজার ৫৬২ জনকে। এসবের মধ্যে গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৮১২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। সাজা হয়েছে ৪০৯ জনের। খালাস পেয়েছেন ১ হাজার ৭২১ জন। মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ৮ জনের। যাবজ্জীবন হয়েছে ২৯৯ জনের। 

 

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ২০০৪ সালের আগের বিভিন্ন সময়ের মামলার আসামি। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের একটি মামলা, পাবনা সদরের একটি মামলা, যশোর বেনাপোলের দুটি মামলা, চাঁদপুর কচুয়ার একটি মামলা এবং যশোর মনিরামপুরের একটি মামলা।

কক্সবাজারের পাচারের ধরন সম্পর্কে আইনজীবী, মানবাধিকার ও এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকার সুযোগে মানব পাচারকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। বর্তমানে পাচারের টার্গেটে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। ছেলেদের চাকরি ও মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাচারের চেষ্টা করা হয়।

কক্সবাজারে নোঙর নামে একটি এনজিও দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের মানব পাচারের মামলা নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের আদালতে এখন পর্যন্ত ৪৬৭টি মামলা বিচারাধীন আছে। ২০১২ সালে কক্সবাজারে মানব পাচারের মামলা হয় ৪১টি, ২০১৩ সালে ৬১টি, ২০১৪ সালে ৭৬টি, ২০১৫ সালে ১২২টি, ২০১৬ সালে ১৩৭টি, ২০১৭ সালে ২৭টি, ২০১৮ সালে ৯টি, ২০১৯ সালে ৪২টি, ২০২০ সালে ৩৩ এবং ২০২১ সালে ১৪টি। প্রায় ৫৬২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ২ হাজার ৩০০ জনকে। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন ৮৫০ জন। নোঙরের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, ২০১২ সালের পর কক্সবাজার থেকে ১ লাখের বেশি মানুষ পাচার হয়েছে। পাচারের শিকার পরিবারগুলো ভোগান্তি ও সমস্যার মধ্যে দিনযাপন করছে। পক্ষান্তরে পাচারকারী ও দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে মানব পাচার থামছে না। স্থানীয় ও রোহিঙ্গারা মূলত পাচারের শিকার হচ্ছে সড়ক, আকাশ ও সাগরসহ সব পথে। কেউ কেউ এককভাবে, আবার গ্রুপ আকারেও পাচারের শিকার হন। এ ছাড়াও অনেকে চাকরি ও বিয়ের প্রলোভনে স্বেচ্ছায় পাচার হচ্ছেন। আর এর নেপথ্যে রয়েছে মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। নোঙরের তথ্যমতে, ২০১২ সালের পর থেকে কক্সবাজারে মানব পাচার বেড়ে গেছে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানব পাচার বন্ধ ছিল। ২০১৯ সাল থেকে সমুদ্রপথে মানব পাচার পুনরায় শুরু হয়েছে। সাগরপথে পাচারের শিকার আবদুর রহমান নামে একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তার এক বন্ধু মালয়েশিয়ায় থাকেন। সেখানে ভালো আয় রোজগারের প্রলোভনে পড়ে ২০১৯ সালে মালয়েশিয়াতে পাঠাতে দালালরা তাকে নৌকায় তুলে দেয়। যাওয়ার পথে ছেড়াদিয়া দ্বীপে পাথরের ধাক্কায় নৌকাটি এক পাশে হেলে যায়। পরে আবদুর রহমান জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯-এ ফোন করলে উদ্ধার হন। এর আগে তাদের পাচারের উদ্দেশ্যে টেকনাফের নোয়াখালী নামে একটি স্থানে রাখা হয়। সেখানে মারধর করে টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়। এরপরই নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। তার বাড়ি কক্সবাজারের ইনানীতে। তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিশ্বজিৎ ভৌমিক জানান, মামলাটি উখিয়া থানায় হয়েছিল। তা এখনো তদন্তাধীন। পাচারের ঘটনায় একজন বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়েছিলেন। আর বাকি সব অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা। এরা সাগরপথে নৌকায় করে শতাধিক ব্যক্তিকে পাচার করেন। যাদের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। তারা সবাই পলাতক রয়েছেন। সিআইডির ট্রাফিকিং অ্যাগেনেইস্ট হিউম্যান বেয়িং (টিএইচবি)-এর অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান জানান, দীর্ঘ সময়ে বিচারের বিষয়ে তারা কিছু বলতে পারবেন না। তবে তারা তদন্ত পর্যায়ে মানব পাচারে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে পারেন না। কারণ এদের বেশির ভাগই বিদেশে অবস্থান করেন।

 এদিকে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া তিন কিশোরী এক বছরের বেশি সময় ধরে বেঙ্গালুরুর সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র ‘গভর্নমেন্ট চিলড্রেন হোম ফর গার্লস’-এ রয়েছে। ভালো বেতনের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র পরিবারের এই তিন কিশোরীকে ভারতে পাচার করে একটি চক্র। এই তিন কিশোরীর মধ্যে দুজনের বাড়ি ফরিদপুরে। একজনের মাদারীপুরে। ফরিদপুর থেকে পাচার হওয়া দুই কিশোরীর বয়স ১৫ ও ১৬ বছর। তারা পূর্বপরিচিত। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রলোভনে পড়ে তারা একসঙ্গে ঘর ছাড়ে। পাচার চক্রের লোকজন তাদের প্রথমে কলকাতায় নিয়ে যায়। বাড়ি ছাড়ার তিন দিন পর ১৬ বছরের কিশোরীটি মোবাইল ফোনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে জানিয়েছেন তার মা। তাদের ফেরাতে চেষ্টা করছে সিআইডিসহ বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জুয়েল মুন্সি সুমন জানান, মানব পাচার মামলাগুলোর দীর্ঘ সময় বিচারাধীন থাকার ৩/৪টি কারণ থাকে। এর প্রধান কারণ হলো সাক্ষী না পাওয়া। যেহেতু মানব পাচারের ঘটনায় প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষী বা কাগজপত্রের প্রমাণাদি থাকে না, তাই অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পরোক্ষ সাক্ষী থাকে। আর প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকলেও আদালতে তাদের হাজির করাও অনেক কঠিন হয়।

সর্বশেষ খবর