শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রাণ ঝরছে টিকটকে

জিন্নাতুন নূর

প্রাণ ঝরছে টিকটকে

টিকটক নামক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম ব্যবহারে উদ্বেগজনক হারে ঝরছে অ্যাপটির ব্যবহারকারীর প্রাণ। টিকটকে বিপজ্জনক স্টান্ট করতে গিয়ে অনেকেই হচ্ছেন গুরুতর আহত। বিশেষ করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং কিশোর বয়সীরা বিভিন্ন সময় টিকটকে আপলোডের জন্য  ট্রেনের ওপর, ব্রিজের ওপর এবং উঁচু দালানের ওপর বিপজ্জনক ভিডিও বানাচ্ছে। এতে বিভিন্ন সময় তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এদিকে ‘ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ’-এর প্ররোচনায় টিকটক করতে গিয়ে বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীরা মৃত্যুর মুখে পড়ছে কি না তা তদন্তের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অ্যাপ ব্যবহারে কোনো বিধিনিষেধ না থাকার কারণে অ্যাপটির যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। যদি সরকারিভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাহলে অ্যাপটির এত অপব্যবহার হতো না। তবে যুবসমাজকে এসব অ্যাপ সম্পর্কে আরও সচেতন করতে হবে। এ ছাড়া ব্যবহারকারীদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হবে।

১১ জুলাই টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মেহেদী হাসান (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। কুমিল্লার লাকসাম পৌর শহরের দৌলতগঞ্জ বাজারে চাঁদপুর রেলগেট এলাকায় বেলা ১১টায় এ ঘটনা ঘটে। মেহেদীর বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামে। কিশোরের সহপাঠীরা জানায়, চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুরগামী সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে সহপাঠীদের নিয়ে ফেনী থেকে লাকসামে যাচ্ছিল মেহেদী। টিকটক ভিডিও বানানোর জন্য নাচতে গিয়ে ডিশলাইনের তারে পা পেঁচিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে যায় সে। ট্রেনের নিচে পড়ে কিশোরটির দেহ ছয় টুকরো হয়ে যায়। নোয়াখালীর চাটখিলে টিকটক ভিডিও ধারণ করার সময় অসাবধানতাবশত গলায় ফাঁস লেগে সানজিদা আক্তার (১১) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। ৭ জুলাই উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। সানজিদা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। জানা যায়, পরিবারের সবার অজান্তে সানজিদা আলমারির ওপর উঠে ঘরের আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস নেওয়ার টিকটক ভিডিও ধারণ করতে যায়। তখন অসাবধনতাবশত পা ফসকে গেলে আলমারি থেকে পড়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস লাগে।

৬ জুলাই রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার একটি সড়কে টিকটকের জন্য মোটরসাইকেল চালানোর দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করার সময় গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিন বন্ধু আহত হয়। আহত তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। উপজেলার তাহেরপুর-শিকদারী সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কিশোরের নাম আফিফ হোসেন (১৫)। সে জামগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল।

চলতি বছর ২০ মে নীলফামারীর সৈয়দপুরে টিকটক করতে গিয়ে নদীতে ডুবে মোস্তাকিন (১৬) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। উপজেলার বোতলগাড়ী ইউনিয়নের খড়খড়িয়া নদীর দীঘলডাঙ্গী ব্রিজে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, ঘটনার দিন মোস্তাকিন তার কয়েক বন্ধুকে নিয়ে বাড়ির পাশের খড়খড়িয়া নদীর দীঘলডাঙ্গী ব্রিজে যায়। এ সময় টিকটক তৈরির জন্য নদীর ব্রিজের ওপর থেকে পানিতে লাফ দেয় মোস্তাকিন। সে দৃশ্য বন্ধুরা তার মোবাইলে ফোন থেকে ভিডিও করছিল। লাফ দেওয়ার পর পানিতে ডুবে কিশোরটি নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে ২ মার্চ রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলায় রেল ব্রিজের ওপর টিকটক করতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে আলহাজ হোসেন (১৬) নামের কিশোরের মৃত্যু হয়। এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় উপজেলার কালিকাপুর রেল ব্রিজে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আলহাজ হোসেন পাংশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কালিকাপুর রেল ব্রিজে ঘুরতে যায়। এরপর সে ব্রিজের ওপর উঠে মোবাইল ফোনে টিকটক ভিডিও করার জন্য শুটিং শুরু করে। এ সময় রাজবাড়ীগামী একটি ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘টিকটকের অপব্যবহার আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকি। একইভাবে এটি জননিরাপত্তার ওপরও হুমকি। সবকিছুরই ভালো ও খারাপ দুই ধরনের ব্যবহার আছে। যেহেতু তরুণরা অবাধে এ অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, এ জন্য এর অপব্যবহারও রোধ করা যাচ্ছে না। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ব্যবহারকারীরা যাতে এ অ্যাপগুলো যথেচ্ছ ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে।’

টিকটক করতে গিয়ে তরুণ প্রজন্ম মৃত্যুর মুখে পড়ছে কি না তা তদন্তের দাবি : ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জের প্ররোচনায় টিকটক করতে গিয়ে বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীরা মৃত্যুর মুখে পড়ছে কি না তা তদন্তের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ এ দাবি জানান। ব্ল্যাকআউট হলো এমন একটি চ্যালেঞ্জ, যেখানে তরুণ-তরুণীকে তার বেল্ট অথবা অন্য কিছু ব্যবহার করে ফাঁসিতে ঝুলতে বা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেয়।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিলাম টিকটককে নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে হাই কোর্টে রিট করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই টিকটককে জবাবদিহির আওতায় ও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।’ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটরদের জনসচেতনতা তৈরিতে নিষ্ক্রিয়তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় দিন দিন টিকটকের অপব্যবহার বেড়েই চলেছে।’

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর