রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ঘরে থেকে সাজাভোগ বাড়ছে

♦ পাঁচ বছরে এ সুবিধা পেয়েছেন ৬৪৫৪ জন ♦ অপরাধপ্রবণতা কমাতে সহায়তা করবে, মত আইনজ্ঞদের

আরাফাত মুন্না

ঘরে থেকে সাজাভোগ বাড়ছে

ফেনসিডিল রাখার দায়ে ১৫ জুন বরিশালে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয় মেহেদী হাসান নামে এক যুবকের। রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেও জীবনে প্রথম অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে ওই যুবককে কারাগারে পাঠাননি আদালত। অসুস্থ মায়ের সেবা করাসহ তিন শর্তে নিজের বাড়িতে থেকেই সাজা ভোগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাকে। শর্ত মানছেন কি না, তা তদারকিতে দায়িত্ব দেওয়া হয় সমাজসেবা কার্যালয়কে। বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা এ রায় দেন।

শুধু মেহেদী হাসানই নয়, এখন আইনিভাবেই লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামিকে প্রবেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে কারাগারে না পাঠিয়ে পারিবারিক পরিবেশে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। গত পাঁচ অর্থবছরে ৬ হাজার ৪৫৪ জন আসামিকে এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ১৯৬০ সালের দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্সের অধীনে ছোটখাটো অপরাধে দণ্ডিতরা এমন সুযোগ পাচ্ছেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, এ আইনের সঠিক প্রয়োগ সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমাতে সহায়তা করবে।

১৯৬০ সালের ওই অধ্যাদেশে প্রবেশনে পাঠানোর সুযোগ থাকলেও চার বছর আগে এর তেমন প্রয়োগ ছিল না। ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ওই অধ্যাদেশ কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিজ্ঞপ্তি জারির পর প্রয়োগ বেড়েছে ৬২ বছরের পুরনো এই অধ্যাদেশের। ধারাবাহিকভাবে লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রবেশনে পাঠানোর হার বাড়ছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবেশনে পাঠানো হয় মাত্র ১৭১ আসামিকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে হয় ২৫৭ জন। আর অধ্যাদেশ জারির পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবেশনে পাঠানো হয় ১ হাজার ১১৪ জনকে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৪৭ জন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৫ জনকে প্রবেশনে পাঠিয়েছেন আদালত। গত জুনে সারা দেশে প্রবেশন কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন ৪ হাজার ৬৭৫ জন আসামি। ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিনেন্স’ অনুযায়ী, একজন আসামিকে জেলে না পাঠিয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে প্রবেশনে পাঠানো হয়। দণ্ডিত আসামির বয়স, স্বভাব-চরিত্র, অতীত কর্মকাণ্ড, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, অপরাধের ধরন ও সাজা বিবেচনা করে প্রবেশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। প্রবেশনে পাঠানো আসামিকে বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়। আসামিকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলে তাকে হাজির হতেই হবে। শর্ত ভঙ্গ করলে তাকে পাঠানো হয় কারাগারে।

ওই আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ ১৮৬০ সালের দণ্ড বিধির ষষ্ঠ (রাষ্ট্রবিরোধী) ও সপ্তম অধ্যায়ের (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সংক্রান্ত) অপরাধ বা দণ্ডবিধির ২১৬(ক), ৩২৮, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯, ৪০১, ৪৫৫, ৪৫৮ ধারার অপরাধ অথবা মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ ব্যতীত অন্য কোনো দণ্ডনীয় অপরাধে দণ্ডিত হলে এ আইনে সুবিধা পাবেন। কোনো নারী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধ ব্যতীত অন্য কোনো দণ্ডনীয় অপরাধে দণ্ডিত হলে অপরাধের প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা, অপরাধীর চরিত্র ইত্যাদি বিবেচনা করে আদালত শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে প্রবেশনে পাঠাতে পারেন। আর শিশু আইনের অধীনে প্রতিটি শিশুই প্রবেশনের সুবিধা পাবে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জীবনে প্রথম অপরাধ করেছেন, কোনো দিন জেলখানায় যাননি, এমন আসামিদের যদি কারাগারে পাঠানো হয়, তাহলে অনেক সময় তারাও বড় অপরাধে জড়িয়ে যান। তাই ছোটখাটো মামলার আসামিদের সংশোধনের সুযোগ দিতেই ১৯৬০ সালে ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিনেন্স’ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আইনে সুযোগ থাকলেও আসামিকে প্রবেশনে পাঠানোর খুব একটা প্রচলন ছিল না। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিজ্ঞপ্তি জারির পরই মূলত এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আমাদের অধস্তন আদালতের বিচারকরাও খুবই উৎসাহের সঙ্গে এ আইনের প্রয়োগ করছেন।’

আসামিকে ঘরে থেকে সাজাভোগের সুযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ছোটখাটো অপরাধে দণ্ডিত, অথবা প্রথমবার সাজা পেয়েছেন, যাদের অতীত রেকর্ড ভালো এমন আসামিদের কারাগারে রাখা হলে তারা ভয়ংকর অপরাধীদের সঙ্গে মিশে নিজেরাও ভয়ংকর অপরাধী হয়ে যেতে পারেন। এ কারণে প্রবেশন ব্যবস্থা খুবই কার্যকর একটি ব্যবস্থা।

তিনি বলেন, তবে যে প্রবেশন কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকবেন, তাকে অবশ্যই নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। শর্তগুলো পালন করা হচ্ছে কি না তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ছোটখাটো অপরাধের আসামিদের বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দিলে এটা সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমাতে সহায়তা করবে বলেই মনে করেন এই আইনজীবী।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর