রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পল্লবীর জোড়া খুন এখনো রহস্যে

বারবার তদন্ত সংস্থা বদল

মাহবুব মমতাজী

প্রায় সাত বছর আগে রাজধানীর পল্লবীতে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। থানা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাত ঘুরে ওই মামলার এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কোনো সংস্থাই এ পর্যন্ত খুনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।

তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখনই তারা রহস্যের কাছাকাছি পৌঁছেছেন, তখনই মামলাটি বদলির আদেশ করানো হয়েছে। এর নেপথ্যে তারা মামলার বাদীর দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছেন। তাদের প্রশ্ন- তাহলে মামলার রহস্য আটকাতেই কি তদন্তের হাত বদল হয়েছে বার বার?

২০১৫ সালের ১৩ মে দুপুর আড়াইটায় বাসায় ঢুকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী সুইটি আক্তার (২৫) ও তার মামা আমিনুল ইসলামকে (৪০) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় তার ছেলে সে সময়ের ৫ বছর বয়সী সাজিদ বিন জাহিদ সাদও আহত হয়। রাজধানীর পল্লবীর ২০ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর ‘ক্রিস্টাল ডি আমিন’ নামে একটি বাড়ির ৬ষ্ঠ তলায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর পরই ওইদিন সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে বাড়ির দারোয়ান আবদুল খালেক এবং আশরাফুল আলম চিশতি শাহীনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পল্লবী থানা পুলিশ। পরে শাহীনকে রিমান্ডে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ ঘটনায় জাহিদুল ১৪ মে বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩২। মামলায় তার ব্যবসায়িক অংশীদার আশরাফুল আলম চিশতি শাহীন, সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশ গ্রুপ ও জিসানসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১৪ মে থেকে ২০ জুন পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই মো. রাসেল। বর্তমানে তিনি ডিবির পুলিশ পরিদর্শক। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার তদন্তভার চলে যায় ডিবিতে। সেখানে ২০১৫ সালের ২১ জুন থেকে ২০১৬ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। এরপর আদালতের মাধ্যমে মামলাটির তদন্ত চলে যায় সিআইডিতে। সেখানে সিআইডির এসআই মোফাজ্জল হোসেন ২০১৬ সালের ২৯ জুন থেকে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন। এরপর তদন্তভার চলে যায় সিআইডির পরিদর্শক মোকছেদুর রহমানের কাছে। তিনি ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত তদন্ত করেন। ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট থেকে গত বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত তদন্ত করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথ। তিনি বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি)। তিনি গত বছরের ১ জানুয়ারি আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। রতন কৃষ্ণ নাথ এ প্রতিবেদককে বলেন, সেটি অনেক পুরনো মামলা। ওই মামলার তদন্ত আমার আগে আরও কয়েকজন করেছেন। তবে কী কারণে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল, তা এই মুহূর্তে আমার স্মৃতিতে নেই। আর মামলাটির আলামতও ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর মামলার বাদী আদালতে নারাজি দিলে গত বছরের ২৮ মার্চ তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়া হয়। এখানে মামলাটির তদন্ত করছেন পরিদর্শক আবদুস ছালাম। তিনি জানান, তারা এখনো মামলাটির কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। তবে সুইটির ছেলেকে এনে খুনিদের বিষয়ে কিছু আকার আকৃতি নেওয়া হয়েছিল। আর বাদী তার সন্দেহের তীর তার বন্ধু শাহিনের দিকেই দিয়ে আসছেন। আগের তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলাটির তদন্ত আমি যখন করছিলাম, তখন রহস্যের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমার বদলি হয়ে যায়। আমি ছাড়াও আগের তিন তদন্ত কর্মকর্তা মিলে আমরা কিছু হিসাব মিলিয়েছিলাম। এতে বাদীরই সংশ্লিষ্টতা কিছু পাওয়া গিয়েছিল। পরে আমরা বাদী পরিবর্তন করে নিহত সুইটির মাকে বাদী করতে আদালতে আবেদন দিয়েছিলাম। কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেননি। বাসার সামনে একটি সিসি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু তার ফুটেজ পাওয়া যায়নি। মামলার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় মামলার বাদী জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি এখন একটা মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলব। আগের আরও কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, যখনই মামলাটির রহস্যের কাছাকাছি তারা পৌঁছেছেন, তখনই রহস্যজনকভাবে মামলার বাদী মামলাটির তদন্তের হাত বদলিয়েছেন। তবে এজহারভুক্ত আসামি শাহিনের কোনো সংশ্লিষ্টতা তারা খুঁজে পাননি। বরং সন্দেহ বারবারই গিয়েছে বাদীর দিকে। তাদের মনে হয়েছে, খুনটি করানো হয়েছে পেশাদার খুনি দিয়ে।

এদিকে পল্লবী থানা সূত্রে জানা গেছে, মামলার এজাহারভুক্ত সন্দেহভাজন আসামি আশরাফুল আলম চিশতি শাহিন জামিনে রয়েছেন। ‘ডেসকো’র চাকরির পাশাপাশি ‘ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার’ নামে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি অংশীদারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলামের। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে ছিলেন। চেয়ারম্যান ছিলেন তার স্ত্রী সুইটি ইসলাম। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে ছিলেন আশরাফুল আলম চিশতি শাহিন। সে সময় পুলিশকে শাহিন জানান, ১৩ মে দুপুরে জাহিদুল তাকে ফোনে বলেন- ‘বন্ধু, তুমি তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসো, সব শেষ হয়ে গেছে’। তখন বাসায় গিয়ে দেখি, তার স্ত্রী ও মামা মারা গেছেন। এরপর আমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু সমস্যার কারণে তারা ব্যবসায়ের অংশীদারিত্ব ভাগাভাগির কথা বলেন। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ১২ মে রাত ১১টা পর্যন্ত তাদের মিটিং হয়েছিল। কিন্তু পরের দিনই খুনের ঘটনাটি ঘটে।

সর্বশেষ খবর