মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে যুক্ত করা হয়েছে সাইবার, পর্নোগ্রাফি ও জুয়াকে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রস্তাবনা অনুযায়ী আইনটিতে ওইসব অপরাধ সম্পৃক্ত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের মে মাস থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে এটি আইন মন্ত্রণালয়ে প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায় রয়েছে। সাইবার অপরাধ ও পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত অপরাধকে মানি লন্ডারিং আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে ২০১৯ সালের ২৯ মে বিএফআইইউকে চিঠি দেয় সিআইডি। এরপর বিএফআইইউ ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর এবং ৩ অক্টোবর সাইবার ও পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবনা পাঠাতে আরেকটি চিঠি দেয়।
বিএফআইইউ সূত্র জানায়, প্রক্রিয়াটির সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৩১ আগস্ট সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভায় জুয়া, সাইবার ও পর্নোগ্রাফির অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করার বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন এটি প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায় রয়েছে।সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির জানান, ওই তিনটি বিষয়কে মানি লন্ডারিং মামলার প্রেডিকেট অফেন্সে যুক্ত করার বিষয়টি সমন্বয় করছে বিএফআইইউ। সবকিছু শেষে এখন সেটি প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষায়। সিআইডি সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২(শ) ধারায় দুর্নীতি ও ঘুষ, মুদ্রা জাল, দলিল দস্তাবেজ জাল, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, অবৈধ মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা, চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি, খুন ও গুরুতর শারীরিক ক্ষতি, নারী-শিশু পাচার, চোরাকারবার, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, মানব পাচার, যৌতুক, চোরাচালানি ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ, কর সংক্রান্ত অপরাধ, মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থ জোগান, ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন, পরিবেশগত অপরাধ, যৌন নিপীড়ন, পুঁজিবাজার সম্পর্কিত অপরাধ, সংঘবদ্ধ অপরাধ বা অপরাধী দলে অংশগ্রহণ এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়সহ মোট ২৭ ধরনের অপরাধের বিবরণ দেওয়া রয়েছে। একই ধারায় ২৮ নম্বর ক্রমিকে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য যে কোনো অপরাধকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিএফআইইউকে লেখা সিআইডির চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, সম্প্রতি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরি কিংবা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো সংঘটিত অপরাধ কিংবা কথিত শিশু সাহিত্যিকের মাধ্যমে কয়েক শ বাংলাদেশি পথশিশুকে দিয়ে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি তৈরি ও বাজারজাত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন, জুয়া বা অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জিত হলেও মানি লন্ডারিং আইনের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ, পর্নোগ্রাফি ও চাইল্ড পর্নোগ্রাফি, জুয়া ও অনলাইন জুয়াকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২(শ)(২৮) ধারা অনুযায়ী সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সিআইডির আরেক চিঠি থেকে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধে আইসিটি আইন-২০১৩ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৬৪৭টি মামলা হয়েছে। যেখানে প্রতি বছর সাইবার অপরাধে মামলা বেড়েছে। ২০১৩ সালে মামলা হয়েছে ৩০টি। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ১৬৩টি, ২০১৫ সালে ৩৫৫টি, ২০১৬ সালে ৬৭৩টি, ২০১৭ সালে ৭৬৮টি এবং ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ৬৮২টি। আবার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সাইবার ক্রাইম বিষয়ক ২০১৮ সালে তাদের বার্ষিক প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়, শুধু ২০১৮ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার ক্রাইমের কারণে ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সিআইডিও মনে করে যে, প্রায় সব অপরাধের সঙ্গেই আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত না হলে প্রকৃত অপরাধীরা নাগালের বাইরে থেকে যায়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তদন্তকালে এর সঙ্গে যুক্ত আসামিদের অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল অর্থের সন্ধান পায় তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় তার অবৈধ অর্থের সূত্র খোঁজা সম্ভব হয়নি। ঠিক একইভাবে সাইবার অপরাধসহ পর্নোগ্রাফি সংশ্লিষ্ট মামলা তদন্তকালে অপরাধীদের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের তথ্য মিলে। আইনি বিধান না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।