বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় জিম্মি ইলেকট্রিক শক

৫ শতাধিক লোক পাচার করেছেন শালা-দুলাভাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে দালালদের ৭ লাখ টাকা দিয়ে দুবাইয়ের বিমান ধরেন একসময়ের সৌদি প্রবাসী মো. সফিকুল ইসলাম। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দুবাই, সিরিয়া হয়ে পৌঁছান লিবিয়ার মিসরাত শহরের একটি বাসায়। মাঝপথে অনাহারে কাটলেও মিসরাতের বাসাটি যে টর্চার সেল সেটি স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। একটি ফ্ল্যাটের ছোট ছোট রুমে রাখা হয় তার মতোই ইতালিগামী ৪২ জনকে। কিছু সময় পর পর একেকজনের ডাক পড়তে থাকে টর্চার সেলে। সেখান থেকে ভেসে আসতে থাকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডাক পড়ে সফিকুলেরও। টর্চার সেলে ঢুকতেই শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। চড়-লাথি-কিল-ঘুসিতে মিলিয়ে যায় ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন।

ততক্ষণে সফিকুল বুঝতে পারেন পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। মার খেয়ে কাঁদলে নির্যাতন বেড়ে যেত কয়েক গুণ। একপর্যায়ে গ্রামের বাড়িতে ফোন করে ৫ লাখ টাকা পাঠানোর জন্য ফোন করতে বলে টর্চার সেলের সদস্যরা। জোর করে নেয় পরিবারের সদস্যদের নম্বরও। কিন্তু পরিবারের কাছে টাকা না চাওয়ায় দেওয়া হয় ইলেকট্রিক শক। চুল ধরে দেয়ালে আঘাত করা হয়। এভাবে টর্চার সেলের তিনজন নির্যাতন করতে থাকে প্রতিদিন। এরই মধ্যে চক্রের সদস্যরা নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারকে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলে। না হলে বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। যাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়, তাদের জোর করে ধরে নিয়ে যায় অন্য একটি চক্রের সদস্যরা। বিক্রি হওয়া ব্যক্তিদের কপালে কী জোটে সেটি হয়তো জানতে পারে না কেউ। লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ভুক্তভোগী মো. সফিকুল ইসলাম ওরফে শফিউল্লা শেখ টর্চার সেলের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শুধু সফিকুল নন, লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইতালিগামীদের সবার কপালেই জোটে টর্চার সেলের ভয়ংকর নির্যাতন। বিক্রি হওয়ার পর অনেককে চিরকালের জন্য দাসত্ব বরণ করে নিতে হয়। সফিকুলকেও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল ১০ লাখ টাকায়। কিন্তু তাকে হস্তান্তরের আগেই মানব পাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে সফিকুলকে দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন বাদশা ও তার চাচাতো ভাই রাজীব মোল্লা। শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ডিবি বলছে, এই চক্রের মূল হোতা বাদশার বোনজামাই সুলতান ৯ বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। সুলতানের বাড়ি গাইবান্ধায়। তাদের এই শালা-দুলাভাই চক্র পাঁচ শতাধিক লোককে লিবিয়ায় পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই টাকা দিয়ে আলিশান বাড়ি ও বিলাসবহুল গাড়িও কিনেছেন তারা। পাচারের শিকার পিরোজপুরের নাজিরপুরের বাসিন্দা সফিকুল বলেন, ‘ছয় বছর সৌদি আরবে ছিলাম। সেখানকার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি মাদারীপুরের বাদশার মাধ্যমে ইতালি যাওয়া যায়। পরে ২৪ মে দেশে ফিরে বাদশার সঙ্গে দেখা করে ১৩ লাখ টাকায় দুবাই, সিরিয়া ও লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয়। ৭ লাখ টাকা অগ্রিম নেন বাদশা চক্র। তাদের কথা মোতাবেক ৪ অক্টোবর দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা হই। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কুমিল্লা-বিক্রমপুর-চট্টগ্রাম থেকে আসা আরও ছয়জনের সঙ্গে দেখা হয়। সবাই বাদশা ও রাজীবের মাধ্যমে ইতালি যাচ্ছিলেন। দুবাইয়ে রাজীবের সহযোগী সবুজ আমাদের রিসিভ করেন। সবুজের বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি আমাদের সাতজনকে একটি রুমে আটকে রাখেন। দুবাইয়ে ১১ দিন রাখা হয়। সেখান থেকে বিমানে সিরিয়ায় নেওয়া হয়। সিরিয়ায় এই চক্রের পাঠানো ৪২ জন মিলিত হই। আমাদের খাবার দেওয়া হতো না। ট্যাবের পানি খেয়ে বিমানবন্দরে তিন দিন কাটিয়েছি। পরে আমাদের লিবিয়ার বেনগাজি নিয়ে দুই ঘণ্টা রাখার পর মিসরাতের টর্চার সেলে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়।’

সর্বশেষ খবর