বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নির্ভার শুরু চ্যালেঞ্জে শেষ

রফিকুল ইসলাম রনি

নির্ভার শুরু চ্যালেঞ্জে শেষ

ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিচ্ছে ২০২২ সাল। গত একটি বছর কেমন ছিল আওয়ামী লীগের! এ হিসাব এখন দলের ভিতরে। জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার জয়ের মাধ্যমে নির্ভার বছর শুরু করে ক্ষমতাসীনরা। বছরের মাঝামাঝি থেকে বিদেশি চাপ এবং সেপ্টেম্বর থেকে কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি মাঠে থাকায় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জে পড়ে আওয়ামী লীগ।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি তিনটি সিটি কপোরেশন নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, সংসদ উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ভোট এবং জেলা-উপজেলা সম্মেলন, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলনে গত একটি বছর পার করল দলটি। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর দলের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছরটি আমাদের জন্য যেমন সাংগঠনিক সফলতার বছর, তেমনি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। বিএনপি নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। তাদের ভাবসাব, কথাবার্তায় এমন দম্ভোক্তি প্রকাশ পেয়েছে যে, আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করেই ফেলবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। জনগণের পাশে থাকায় তারা সুপারফ্লপ খেয়েছে। চ্যালেঞ্জে আমরা সফল হয়েছি।

আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এ ছাড়া সাড়ে ছয় শতাধিক সাংগঠনিক উপজেলা-থানা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব জেলা-উপজেলা, থানা, পৌরসভায় সম্মেলন করা যায়নি। করোনার কারণে একাধিকবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। বিদায়ী বছর করোনার প্রকোপ কিছুটা কম থাকায় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কাজে মনোযোগী হয়। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ছুটে বেড়ান জেলা-উপজেলা সম্মেলন নিয়ে। বিদায়ী বছর ঢাকা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, বরগুনা, কুমিল্লা মহানগর, কুমিল্লা দক্ষিণ, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, জামালপুর, নোয়াখালী, কক্সবাজার, মাগুরা, নওগাঁ, নাটোর, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ অর্ধশতাধিক জেলায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। এ ছাড়া চার শতাধিক উপজেলা সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। তৃণমূলের এসব সম্মেলন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলন করা হয়। এ ছাড়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের সম্মেলন হয়েছে। এ চার সংগঠনেই নতুন নেতৃত্বের ক্ষেত্রে চমক দেখা গেছে। ২৪ ডিসেম্বর ছিল আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ জন্য পুরনোতেই আস্থা রেখেছেন দলীয় সভানেত্রী।

এমপি-মন্ত্রীদের কারণে অস্বস্তি : গত এক বছরে সরকারে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ এমপি-মন্ত্রীর বেফাস মন্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে-বাইরে ছিল নানা অস্বস্তি। সরকারি কর্মকর্তাদের গায়ে হাত তোলা, কলেজ শিক্ষককে পেটানো, নিজ দলের নির্বাচিত চেয়ারমানকে মারধর, আধিপত্য বিস্তারের নামে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দলীয় নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় কমপক্ষে সাতজন এমপিকে দলের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে তাদের। এক-দুজনকে দেওয়া হয়েছে কারণ দর্শানো নোটিসও। ফলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের কারণে অস্বস্তিও ছিল আওয়ামী লীগের ভিতরে। এ ছাড়া গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ বন্ধ করার তাপ আওয়ামী লীগের গায়ে লেগেছে।

বিদেশি চাপ ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি থাকলেও এ নির্বাচন নিয়ে মাঠে তৎপর বিদেশি কূটনীতিকরা। অন্যদিকে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ নিয়ে দূতাবাসগুলোতে ধরনা দিয়েছে। বিএনপির সভা-সমাবেশ নিয়েও কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে বিবৃতি এসেছে। এসব চাপ সামলাতে হয়েছে সরকার ও দলকে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে জ¦ালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের দামেও। এটাকে সামনে রেখে গত সেপ্টেম্বর থেকে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। প্রথম সমাবেশগুলোকে গুরুত্ব না দিলেও বাস মালিকদের ‘কথিত ধর্মঘট’ এবং নানা বাধা সমাবেশগুলোয় জনসমাগম ঘটে। এটা দেখে নড়েচড়ে বসে আওয়ামী লীগ। সে সময় দলটির দায়িত্বশীল নেতারাও মিডিয়াকে দোষারোপ করতে থাকেন। তাদের অভিযোগ, সমান কাভারেজ দেওয়া হচ্ছে না। বিএনপি কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশ করার পর আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে। সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ ছিল আওয়ামী লীগের জন্য ১০ ডিসেম্বরকে মোকাবিলা করা। ‘১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নির্দেশে’ বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের এ বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এসবের মধ্যেই ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের ভেন্যু নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা যে কোনো মাঠে করার কথা বলা হয়। এ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্যে ৭ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি রাজধানীর গোলাপবাগে গরুরহাটে সমাবেশ করে। এ সমাবেশ থেকে সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ ১০ দফা দাবি জানিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ করে বিএনপি। 

নির্বাচন সামনে রেখে মহাসমাবেশ : ঝিমিয়ে পড়া তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে বছরের শেষ দিকে মাঠে নামেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৪ নভেম্বর যশোর, ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে মহাসমাবেশ করেছে দলটি। দীর্ঘদিন পর সমাবেশে দলীয় প্রধানের সশরীরে উপস্থিতি নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করেছে। প্রতিটি সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে। সমাবেশ থেকে আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া গত ১১ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ৫০ বছর উপলক্ষে যুব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

গত বছর কেমন গেল জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন তৃণমূলে সম্মেলন করতে পারিনি। দলীয় সভানেত্রীও সরাসরি মাঠ পর্যায়ে যাননি। কিন্তু গত বছর করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় নেত্রী তিনটি জেলায় বড় সমাবেশ করেছেন। এতে নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছেন। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের ঘুমন্ত নেতা-কর্মীদের জাগিয়ে তুলেছে। যে কোনো সংকটে দলীয় নেতা-কর্মীরা যে ঐক্যবদ্ধ তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

 

সর্বশেষ খবর