শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

পোল্যান্ডে পাঠানোর কথা বলে ভারতে জিম্মি

আলী আজম

ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন হবিগঞ্জের শাহ নেওয়াজ। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন পোল্যান্ডে। ভালো বেতনের আশায় তিনি আঁটসাঁট বেঁধে চেষ্টা শুরু করেন। পেয়ে যান কাক্সিক্ষত লোকও। ৬ লাখ টাকাও দেন। কিন্তু তার ভাগ্য সহায় হয়নি। পোল্যান্ডে নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে শাহ নেওয়াজকে নেওয়া হয় ভারতে। সেখানে তাকে হাত-পা বেঁধে জিম্মি করা হয়। তার পরিবার থেকে মুক্তিপণের টাকাও নেয় প্রতারক চক্র। নিমেষেই তার স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে দেশে ফিরে আসেন শাহ নেওয়াজ। এরপর ডিএমপির নিউমার্কেট থানায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তিনি।

ওই প্রতারক চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের উত্তর বিভাগ।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- নুরজাহান, তার স্বামী আলী আকবর, ওই দম্পতির মেয়ে তানজিন জাহান, নুরজাহানের নাতি ফয়সাল আহমেদ, ট্রাভেল এজেন্সির মালিক সুমন সদাগর ও নুরজাহানের বান্ধবী শাহানা পারভীন। গত ২৯ অক্টোবর তাদের রাজধানীর উত্তরা ও বনানী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

ডিবি বলছে, নুরজাহান এ চক্রের হোতা। পোল্যান্ড পাঠানোর কথা বলে চক্রটি ২১ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

জানা গেছে, হবিগঞ্জের আছকির মিয়ার বন্ধু সাইফুল ইসলাম। তার মাধ্যমে নুরজাহানের সঙ্গে পরিচয় হয় আছকিরের। জানতে পারেন, নুরজাহানের মেয়ে তানিয়া তাহমিনা কলি পোল্যান্ডে থাকেন। কলি কানাডা ও পোল্যান্ডের ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা প্রদান করেন। ইউরোপে দেশ পোল্যান্ড গেলে ভাগ্য ফিরে যাবে প্রতারকদের কাছ থেকে এমন আশ্বাস পেয়ে আছকির তার ছেলে শাহ নেওয়াজকে পোল্যান্ড পাঠাবেন বলে ঠিক করেন। এরপর ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় নুরজাহান, তানজিন, ফয়সাল ও আকবরকে ৪ লাখ টাকা দেন আছকির। পরে সুমন পোল্যান্ড যাওয়ার ব্যাপারে ওয়ার্ক আউট পারমিটের কাগজপত্র দেন। গত ২ অক্টোবর পোল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন শাহ নেওয়াজ। ৮ অক্টোবর শাহ নেওয়াজ তার বাবা আছকিরকে ফোন করে জানান, তাকে পোল্যান্ড নয়, ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারতীয় দালাল সুনাম তাকে একটি বাসায় আটকে রেখেছেন। সেখানে দালাল চক্র তার হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করছে। তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরিবারের লোকজন ভয় পেয়ে যান। প্রতারকরা আছকিরের কাছে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। ১১ অক্টোবর আকবরকে ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা নগদ এবং ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা দুটি বিকাশ নম্বরে পাঠান আছকির। টাকা পেয়ে শাহ নেওয়াজকে ছেড়ে দেয় প্রতারকরা। পরে তার পরিবার ভারতে গিয়ে শাহ নেওয়াজকে উদ্ধার করে ১৩ অক্টোবর দেশে ফিরিয়ে আনেন আছকির। এরপর প্রতারকদের বিরুদ্ধে গত ২৯ অক্টোবর ডিএমপির নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগের এসআই ছানোয়ার হোসেন। তিনি তদন্ত নেমে নুরজাহান, তার স্বামী আলী আকবর, ওই দম্পতির মেয়ে তানজিন জাহান, নুরজাহানের নাতি ফয়সাল আহমেদ, ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক সুমন সদাগর ও নুরজাহানের বান্ধবী শাহানা পারভীনকে গ্রেফতার করেন। এর বাইরেও এই চক্রে নুরজাহানের মেয়ে কলি জড়িত, যিনি চীনে অবস্থান করছেন। কলি পোল্যান্ডে অবস্থান করছেন এমন পরিচয় দিয়ে কানাডা ও পোল্যান্ড পাঠানোর কথা বলে বিভিন্ন মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারক চক্র। এরপর দেশে অবস্থানরত চক্রের সদস্যদের কাছে এসব ডকুমেন্ট পাঠায়। চক্রটি এ পর্যন্ত কাউকে পোল্যান্ড পাঠাতে পারেনি। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মহিদুল ইসলাম জানান, ২০২০ সাল থেকে চক্রটি প্রতারণা শুরু করে। এ পর্যন্ত ২১ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে চক্রটি ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগীরা পোল্যান্ড যাওয়ার জন্য নিম্নে ৬ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রতারকদের দিয়েছেন। আসামি নুরজাহানের পরিবারের প্রায় সবাই এ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। চক্রের সঙ্গে সুমন ট্র্যাভেলস এজেন্সির মালিক সুমন ও ভারতীয় নাগরিক সুনাম জড়িত। পাশাপাশি চক্রের মূল হোতা নুরজাহানের বান্ধবী শাহানাও এই চক্রের অন্যতম সদস্য। নুরজাহানের মেয়ে তানজিন ও শাহানা লোক জোগাড় করতেন। নাতি ফয়সাল পোল্যান্ডের বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র দেখাতেন। নুরজাহান ও তার স্বামী আকবর টাকা নিয়ে গ্যারান্টি হিসেবে চেক ও স্ট্যাম্প দিতেন। সুমন ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক সুমন পোল্যান্ডের কথা বলে ভারতে নিয়ে যেতেন। বাংলাদেশে পোল্যান্ডের দূতাবাস নেই বলে ভুক্তভোগীদের ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তাদের তিন-চার দিন হোটেলে রাখা হতো। ভারতের নাগরিক সুনাম তাদের সহযোগিতা করতেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার কারণে পোল্যান্ডের ভিসা বন্ধ রয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের দেশে পাঠিয়ে দিত প্রতারক চক্র। কলি চীনে অবস্থান করলেও এ চক্রের আরেক সদস্য কলির বন্ধু ইমরান পলাতক।

সর্বশেষ খবর