রবিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

জনসমুদ্র তুরাগ তীর, আজ আখেরি মোনাজাত

গাজীপুর ও টঙ্গী প্রতিনিধি

জনসমুদ্র তুরাগ তীর, আজ আখেরি মোনাজাত

তুরাগ তীরে গতকাল মুসল্লির ঢল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের বিশ্ব ইজতেমাস্থল এখন দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির পদচারণে মুখরিত। শিল্পনগরী টঙ্গী এখন যেন পরিণত হয়েছে ধর্মীয় নগরীতে। ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন গতকাল লাখ লাখ মুসল্লি ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র কোরআনের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে পার করেছেন। আজ (রবিবার) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে এ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছে আয়োজক কমিটি। প্রায় ২৫-৩০ লাখ মুসল্লি আখেরি মোনাজাতে অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ময়দানে বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষভাবে স্থাপিত মঞ্চ থেকে এ মোনাজাত করা হবে। এর আগে উপস্থাপন করা হবে হিদায়াতি বয়ান। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে আগামী শুক্রবার শুরু হবে তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। এবারও তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বিরা রেডিও-টিভিতে আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারে অনুমতি দেননি। ক্যামেরায় মুরব্বিদের ছবি তোলাও বারণ করে দিয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ। তার পরও কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইজতেমা কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে মোনাজাত সম্প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তা : গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপির) কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জানান, আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে পুলিশ প্রশাসন বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। শনিবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ-সংলগ্ন রাস্তাগুলো বন্ধ থাকবে।

যে রোডগুলো বন্ধ থাকবে : কামারপাড়া রোড, টঙ্গী থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস, আশুলিয়া অর্থাৎ আবদুল্লাহপুর ব্রিজ থেকে বাইপাইলের রোড বন্ধ থাকবে। সে ক্ষেত্রে ভোগড়া থেকে ৩০০ ফিট পর্যন্ত বাইপাস হয়ে চলে যাবে ঢাকাগামী লোকজন। যেসব মুসল্লি বা লোকজন ময়মনসিংহ বা গাজীপুর যাবেন, তারা বাইপাইল থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা হয়ে ময়মনসিংহের দিকে চলে যাবেন। আখেরি মোনাজাতের দিন আজ সকাল থেকে মুসল্লিদের সুবিধার্থে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত বিআরটিসি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় ১০০ (ইজতেমার স্টিকার লাগানো) শাটল বাস চলাচল করবে। 

দ্বিতীয় দিন (শনিবার) যারা বয়ান করলেন : ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ জানান, নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার মুসল্লিদের উদ্দেশে বাদ ফজর বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা খুরশিদুল হক রায়বেন্ড। সকাল ১০টা থেকে বিশেষ বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। মাদরাসা ছাত্রদের উদ্দেশে বিশেষ বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা খুরশিদ, আরব জামাতের জন্য বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমদ লাট, বোবা ও বধিরদের জন্য বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সানোয়ার, বিদেশি জামাতের মুসল্লিদের উদ্দেশে ইংরেজিতে বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা ইফতার জামান। বাদ জোহর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ফারুক। বাদ আসর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান এবং অনুবাদ করেন মাওলানা যোবায়ের। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করে বয়ান শোনেন। 

বয়ানে বলা হয়, দুনিয়ার জিন্দেগি ক্ষণস্থায়ী। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের দিল থেকে আসবাবের (সম্পদের) এক্বিন বের না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার দিলে কুদরতি এক্বিন পয়দা হবে না। সবাইকে দীনের জন্য মেহনত করতে হবে। আল্লাহর কাছে আমল ছাড়া এ দুনিয়ার জিন্দেগির কোনো মূল্য নেই। বয়ানে আরও বলা হয়, দীনের দাওয়াতের মাধ্যমে ইমান মজবুত হয়। ইমান মজবুত হলে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হাসিল হয়।  আজ আখেরি মোনাজাতের আগে সকাল সাড়ে ৭টায় ভারতের মাওলানা আবদুর রহমান হিদায়াতি বয়ান করবেন। বাংলাদেশের মাওলানা আবদুল মতিন বাংলায় অনুবাদ করবেন। এদিন বিশেষ নসিহত করবেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তাঁর বয়ান বাংলায় অনুবাদ করবেন মাওলানা জুবায়ের আহমদ।

বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ : বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১৫-২০ জন শুরা সদস্য ও বুজর্গ বয়ান করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। মূল বক্তা বয়ানের একটি নির্দিষ্ট অংশ শেষ করার পর অনুবাদের জন্য বিরতি দেন। অনুবাদ শেষ হলে তিনি আবার বয়ান শুরু করেন। এভাবেই ইজতেমা ময়দানে তাবলিগ জামাতের মুরব্বিদের বয়ান চলে।

যৌতুকবিহীন বিয়ে : বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরিয়ত মেনে ইজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) বাদ আসর ইজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। এ সময় ৬৪ জোড়া বিয়ে হয়। ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান এসব বিয়ে পড়ান। কনের সম্মতিতে ও তার অনুপস্থিতিতে বর এবং কনেপক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ওই বিয়ে। গত কয়েক বছর এটি অনুষ্ঠিত হয়নি।

তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসল্লি : ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশগ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইল মসজিদের তাবলিগি মুরব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলিগি কাজে পাঠানো হবে।

সাত মুসল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আগত সাত মুসল্লি শনিবার পর্যন্ত মারা গেছেন। তাদের প্রায় সবাই শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন ইজতেমা ময়দানের জিম্মাদার মাওলানা মোহাম্মদ শাকের। যারা মারা গেছেন তারা হলেন- সিলেটের জৈন্তাপুর থানার হরিপুর হেমুবটেপাড়া এলাকার মৃত ফজলুল হকের ছেলে মো. নুরুল হক (৬৩), গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সদর থানার ভুরুলিয়া এলাকার আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব (৯০), ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার হাজি মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহ হবি (৬৮), খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মলমলিয়া এলাকার মৃত মোবারক হোসেন খানের ছেলে মোফাজ্জল হোসেন খান (৭০), মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার মধ্যেকামার এলাকার আদিল উদ্দিন সিকদারের ছেলে আক্কাস আলী সিকদার (৫০), চট্টগ্রাম সদর উপজেলার রাওজান এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে আবদুর রাজ্জাক (৭০), নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলাার মাছিমপুর এলাকার মৃত রহমতুল্লাহর ছেলে হাবিবুর রহমান হবি (৭০)। এদের মধ্যে ছয়জন বার্ধক্যজনিত ও একজন শ্বাসকষ্টে মারা যান। মৃতদের মধ্যে শনিবার ভোরে দুজন, শুক্রবার তিনজন এবং বৃহস্পতিবার দুজন মারা যান। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন সময়ে ইজতেমা ময়দানে তাদের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ইজতেমায় বিশ্বের ৬৬ দেশের ৫ হাজার ২৮৬ মুসল্লি : টুরিস্ট পুলিশ বাংলাদেশের ডিআইজি মো. ইলিয়াস শরীফ বলেন, বিদেশি মুসল্লিদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এবারই প্রথম ইজতেমায় কাজ করছে টুরিস্ট পুলিশ। এখন পর্যন্ত ৬৬টি দেশের ৫ হাজার ২৮৬ জন মুসল্লি ইজতেমায় এসেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। আরও কিছু মুসল্লি আসবেন। তিনি গতকাল সকালে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়াম পুলিশ কন্ট্রোল রুমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য জানান। তবে ইজতেমার প্রথম পর্বের গণমাধ্যমবিষয়ক সমন্বয়কারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম জানান, গতকাল পর্যন্ত সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, কাতার, জর্ডান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ৭৫টি দেশের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বিদেশি মেহমান ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। অনেকে এখনো পথে রয়েছেন। এবার ভারতের মুসল্লি বেশি।

ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প : গতকাল সকাল থেকে ইজতেমা ময়দান-সংলগ্ন ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্পগুলোয় মুসল্লিদের চিকিৎসা নিতে ভিড় দেখা গেছে। মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ময়দানের আশপাশে ও মন্নুনগর এলাকায় বিভিন্ন ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। অসুস্থদের অধিকাংশই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, আমাশয়, শ্বাসকষ্টের রোগী।  

বিশেষ ট্রেন : বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে ২১টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া আখেরি মোনাজাতের আগে ও পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে। টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, আজ আখেরি মোনাজাতের দিন জামালপুর-টঙ্গী একটি, আখাউড়া-টঙ্গী একটি, টঙ্গী-ময়মনসিংহ, লাকসাম-টঙ্গী রুটে বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। এ ছাড়াও আখেরি মোনাজাতের আগে-পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে বলে জানিয়েছেন টঙ্গীর রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা।

যার যার ডাইনে চলি ভাই : ময়দানের প্রতিটি প্রবেশপথে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী কর্মী কাজ করছেন। তারা হাতে লাঠি নিয়ে চলার দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন এবং যার যার ডাইনে চলি, জিকিরে ফিকিরে চলি ভাই এসব কথা বলে মুসল্লিদের চলাচলের সুবিধা দিচ্ছেন। মুসল্লিরাও তাদের কথা মতো ডাইনে চলছেন। আর আল্লাহ আল্লাহ বলে জিকির করছেন।

মুসল্লিদের দুর্ভোগ : ইজতেমা ময়দানে জায়গা না পেয়ে রাস্তায়, ফুটপাতে, কিংবা টয়েলেটের সিঁড়ি ও ছাদে অবস্থান নিয়েছেন মুসল্লিরা। এ ছাড়া ময়দানের ভিতর ও চারপাশে ময়লার স্তূপ। ময়লা-আবর্জনার পচা দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ মুসল্লিরা। সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি কেউ দেখছেন না বলে অভিযোগ করেন। আতিকুল ইসলাম নামে এক মুসল্লি বলেন, ময়দানের ভিতরে ময়লার ভাগাড়। দুর্গন্ধে চলাচল কঠিন হয়েছে পড়েছে।

প্রসঙ্গত, আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কাকরাইল জামে মসজিদে প্রথম বিশ্ব ইজতেমার প্রচলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। এরপর ১৯৪৮ সালে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুরের শিল্পনগরী টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

সর্বশেষ খবর