মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বৈশ্বিক সংকট উত্তরণে সহজ পথ নেই : আইএমএফ

আর্থিক খাতের সংস্কার দ্রুত করতে পারলে সফলভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারবে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলমান বৈশ্বিক সংকট উত্তরণের জন্য সহজ কোনো পথ নেই বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এতে বিশ্ব অর্থনীতির অনেকগুলো দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে, যা উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করা আরও কঠিন করে তুলছে। এতে এসব দেশ বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে একাধিক ধাক্কার মুখে পড়েছে বলে মনে করেন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। গতকাল আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট এবং উচ্চ ঋণের মাত্রা কাটিয়ে ওঠার কোনো সহজ উপায় নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, যা অত্যাবশ্যক বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলা করা আরও কঠিন করে তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে এমনকি আমাদের একাধিক ফ্রন্টে আরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা একটি নতুন শীতল যুদ্ধের ভূতের মুখোমুখি হচ্ছি, যা বিশ্বকে প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক ব্লকে বিভক্ত হতে পারে। এটি একটি সম্মিলিত নীতিগত ভুল, যা সবাইকে আরও দরিদ্র ও কম নিরাপদ করে তুলবে। এটি ভাগ্যের একটি অত্যাশ্চর্য বিপরীত হবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক একীকরণ কোটি কোটি মানুষকে ধনী, স্বাস্থ্যবান ও উন্নত শিক্ষিত হতে সাহায্য করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতির আকার প্রায় তিন গুণ বেড়েছে এবং প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই শান্তি ও সহযোগিতার লভ্যাংশ নষ্ট করা উচিত নয়।

ক্রমবর্ধমান খণ্ডিত ঝুঁকি : প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনো সবাই বিশ্বব্যাপী একীকরণ থেকে উপকৃত হয়নি। বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন থেকে স্থানচ্যুতি কিছু সম্প্রদায়ের ক্ষতি করেছে। অর্থনৈতিক উন্মুক্ততার জন্য জনসমর্থন বেশ কয়েকটি দেশে হ্রাস পেয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের পর থেকে, পণ্য ও মূলধনের আন্তসীমান্ত প্রবাহ সমান সমান হচ্ছে। কিন্তু এটা গল্পের অংশ মাত্র। নতুন বাণিজ্য বিধিনিষেধের বৈশ্বিক উত্থানের মধ্যে বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা বাড়ছে। এদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে শুধু মানুষের দুর্ভোগই নয়, সারা বিশ্বে আর্থিক, খাদ্য ও শক্তিপ্রবাহের ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে। অবশ্যই দেশগুলো সর্বদা বৈধ অর্থনৈতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনার জন্য পণ্য, পরিষেবা ও সম্পদের বাণিজ্যের ওপর কিছু বিধিনিষেধ রেখেছে। কভিড-১৯ মহামারি চলাকালে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার দিকেও মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরবরাহ চেইনগুলোকে আরও স্থিতিস্থাপক করা হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে কোম্পানির রিশোরিং, অনশোরিং এবং নিয়ার-শোরিংয়ের আয়ের উপস্থাপনায় উল্লেখ প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। ঝুঁকি হলো যে, অর্থনৈতিক বা জাতীয় নিরাপত্তার নামে গৃহীত নীতি হস্তক্ষেপের অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি হতে পারে, অথবা অন্যের খরচে অর্থনৈতিক লাভের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পলাতক ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজনের দিকে এটি একটি বিপজ্জনক পিচ্ছিল ঢাল হবে। যারা ফ্র্যাগমেন্টেশন (খণ্ডিত ঝুঁকি) দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং হবে। উন্নত অর্থনীতির নিম্ন আয়ের ভোক্তারা সস্তায় আমদানিকৃত পণ্যের অ্যাক্সেস হারাবে। ছোট, মুক্তবাজার অর্থনীতিগুলো হার্ড-হিট হবে। উন্মুক্ত বাণিজ্যের ওপর অত্যধিক নির্ভরতার কারণে এশিয়ার বেশির ভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো আর প্রযুক্তির স্পিলওভার থেকে উপকৃত হবে না, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েছে। উন্নত অর্থনীতির আয়ের মাত্রা ধরার পরিবর্তে উন্নয়নশীল বিশ্ব আরও পিছিয়ে পড়বে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ফোকাস করুন : বাণিজ্য, ঋণ ও জলবায়ু কর্ম। সুতরাং কীভাবে আমরা খণ্ডিতকরণের মোকাবিলা করতে পারি? একটি বাস্তববাদী পন্থা গ্রহণ করে। এর অর্থ হলো এমন ক্ষেত্রে ফোকাস করা যেখানে সহযোগিতা অপরিহার্য এবং বিলম্ব একটি বিকল্প নয়। এর মানে সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের নতুন উপায় খুঁজে বের করা। এ জন্য তিনটি অগ্রাধিকার হাইলাইট করা যাক- প্রথমত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা।

স্বল্প প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিসহ একটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আমাদের আরও শক্তিশালী ট্রেড ইঞ্জিন প্রয়োজন। ২০২৩ সালে বাণিজ্য বৃদ্ধি হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরোপিত বিকৃতিমূলক ভর্তুকি এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাগুলো ফিরিয়ে আনাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার জোরদার সংস্কার এবং ডব্লিউটিওভিত্তিক বাজার-উন্মুক্তকরণ চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাণিজ্যের ভূমিকাকে শক্তিশালী করা শুরু হয়। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন সদস্যপদ, বাণিজ্য নীতির জটিলতা বৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে জটিল বাণিজ্যবিষয়ক সমঝোতা খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং রয়ে গেছে। এদিকে দেশগুলোকে বাণিজ্য বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর দেশে ও বিদেশে খরচগুলো সাবধানে বিবেচনা করা উচিত। একতরফা ক্রিয়াকলাপ থেকে দুর্বলদের রক্ষা করার জন্য আমাদের গার্ডেল তৈরি করতে হবে। একটি ভালো উদাহরণ হলো, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতো মানবিক সংস্থাগুলোতে রপ্তানিকে খাদ্য রপ্তানি সীমাবদ্ধতা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সম্প্রতি বাস্তবসম্মত প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু এই প্রচেষ্টা যদিও গুরুত্বপূর্ণ তবে যথেষ্ট নয়। সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি থেকে শুরু করে চাকরির প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ, শিল্প, অঞ্চল ও পেশাজুড়ে কর্মীদের গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য আমাদের বাড়তি আরও ভালো নীতি দরকার। এভাবে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে বাণিজ্য সবার জন্য কাজ করে। দ্বিতীয়ত, দুর্বল দেশগুলোকে ঋণ মোকাবিলায় সহায়তা করুন। তৃতীয়ত, জলবায়ু-সংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপ বাড়ান। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সমষ্টিগত পদক্ষেপ ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে ঢাকা সফররত আইএমএফের ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেছেন, আর্থিক খাতে আইএমএফের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে বাংলাদেশ চলমান সংকট সফলভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারবে বলে মনে করে আইএমএফ। গতকাল তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। সাক্ষাৎকালে সংস্থাটির ডিএমডি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে চলমান বৈশ্বিক সংকটের প্রসঙ্গেও কথা বলেন। তবে বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ পাওয়ার যোগ্য হিসেবে আরও আগেই বিবেচিত হয়েছে বলে জানানো হয়। ঢাকা সফরের অংশ হিসেবে পদ্মা বহুমুখী সেতু পরিদর্শনেরও কথা রয়েছে তার।

সর্বশেষ খবর