ভয়াবহ বায়ুদূষণ এখন আর শুধু রাজধানী ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে পুরো দেশের বাতাস। এরই মধ্যে দূষণমাত্রায় ঢাকাকে টেক্কা দিতে শুরু করেছে দেশের সাতটি বড় শহর। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট প্রায়ই দূষণে ঢাকাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নরসিংদী, কুমিল্লা, সাভারের বাতাসও উচ্চ মাত্রায় দূষিত থাকছে অধিকাংশ সময়। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে খুলনা ও বরিশালের বাতাস তুলনামূলক কম দূষিত হলেও তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর নয়। পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সব বড় শহরগুলোয় প্রচুর কনস্ট্রাকশন কাজ শুরু হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছোট যানবাহন ও কল-কারখানা বাড়ছে। এগুলোয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে বাতাস। এ ছাড়া ট্রান্স-বাউন্ডারি পলুশনের (সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বাতাস) কারণেও সারা দেশের বাতাস দূষিত হয়ে উঠছে।
পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯ ফেব্রুয়ারি বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২৭৭, যাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওই দিন গাজীপুরের একিউআই স্কোর ছিল ৩০৮ ও রাজশাহীর ৩৫৩, যা চরম অস্বাস্থ্যকর। এ ছাড়া ময়মনসিংহের স্কোর ছিল ২৮৭ ও রংপুরের ২৬৭। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্কোর ছিল ২৪৬। এদিন নারায়ণগঞ্জের স্কোর ছিল ৩৬১, রাজশাহীর ৩৪৪, রংপুরের ২৮৪, গাজীপুরের ২৮০, ময়মনসিংহের ২৬৮, চট্টগ্রামের ২৪৬, কুমিল্লার ১৯৯, সাভারের ১৯২, নরসিংদীর ১৭৪, খুলনার ১৬৬ ও বরিশালের স্কোর ছিল ১৫৯। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্কোর ছিল ১৭৫। ঢাকার চেয়ে বেশি স্কোর ছিল চট্টগ্রামের ২১০, গাজীপুরের ২২০, নারায়ণগঞ্জের ১৭৭, সিলেটের ২৯৬, রাজশাহীর ৩১৬, সাভারের ১৯৬, ময়মনসিংহের ২১৫, রংপুরের ২৫২, কুমিল্লার ১৯৪ ও নরসিংদীর ১৮২। একিউআই স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে তাকে ভালো বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সহনশীল, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ ছাড়িয়ে গেলে দুর্যোগপূর্ণ বা চরম অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হয়। এই অবস্থা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
এদিকে বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর ধরেই বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ শহরের মধ্যে প্রথম তিনে থাকছে ঢাকার নাম। বর্ষাকালে দূষণ কম থাকলেও অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায়ই শীর্ষ দূষিত শহরের খেতাব যোগ হচ্ছে ঢাকার নামের পাশে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি : নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আসায় উল্লেখযোগ্যভাবে শ্বাসকষ্ট, কাশি, শ্বাসনালির সংক্রমণ ও বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ছে। সংস্থাটি ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সারা দেশের বায়ুমানের ওপর গবেষণা করে এই তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ এবং ঢাকা দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসাবে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদফতর দেশের বড় শহরগুলোর বায়ুমান পর্যবেক্ষণ শুরু করলে সারা দেশে দূষণের ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণবিষয়ক গবেষক ড. আবদুস সালাম বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবগুলো দেশে দূষণ বাড়ছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে দূষণ সবচেয়ে বেশি। সন্ধ্যার পর কখনো কখনো ঢাকার বাতাসে দূষণ উপাদান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে ৩৬ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি ভোলার বাতাসেও দূষণমাত্রা ভয়াবহ। রাজশাহীতেও যন্ত্র বসিয়েছি। সেখানেও দূষণ বিপজ্জনক পর্যায়ে। বর্তমানে সারা দেশই ভয়াবহ বায়ুদূষণের শিকার। এই দূষণের পেছনে আমাদের অভ্যন্তরীণ কারণ যেমন আছে, কিছু দূষণ শীতকালে উত্তরের বাতাসের সঙ্গে সীমান্তের ওপার থেকে আসছে। অধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ ও নগরায়ণের কারণেই এই দূষণ। তিনি বলেন, সবগুলো বড় শহরে প্রচুর কনস্ট্রাকশন কাজ হচ্ছে। কিন্তু, ধুলা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। প্রচুর মোটরসাইকেল ও ছোট যানবাহন বাড়ছে। এগুলো জীবাশ্ব জ্বালানি পোড়াচ্ছে। প্রচুর ফিটনেসবিহীন কালো ধোঁয়ার গাড়ি চলছে। দূষণের উৎস বন্ধ করতে আইন আছে, প্রয়োগটা সেভাবে হচ্ছে না। আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করলে দূষণ কমে আসবে।