শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
আজ বিশ্ব শ্রবণ দিবস

শব্দদূষণে জব্দ জীবন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

শব্দদূষণে জব্দ জীবন

সকাল ১০টা। রাজধানীর শাহবাগ মোড় দিয়ে যাতায়াত করছে শত শত যানবাহন। কার আগে কে যাবেন এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে চালকরা বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলেছেন। রাস্তার দুই পাশে হাসপাতালের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে ‘সামনে হাসপাতাল, হর্ন বাজাবেন না’। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই চালকদের। শুধু শাহবাগ নয়, পুরো রাজধানীর চিত্রই এটি।

এ পরিস্থিতির মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শ্রবণ দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য কানের ও শোনার যত্ন’। শব্দদূষণের মাত্রা স্থানভেদে কেমন হবে তার নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের হিসাব অনুযায়ী কোনো এলাকায় ৬০ ডেসিবেল মাত্রার বেশি শব্দ হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে। অফিসকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষে শব্দের মাত্রা হবে ৩০-৪০ ডেসিবেল, হাসপাতাল এলাকায় ২০-৩৫ ডেসিবেল, রেস্তোরাঁয় ৪০-৬০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা সহনীয়। ৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দে মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।

শব্দদূষণের কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় ৪২ শতাংশ রিকশাচালকের শ্রবণজনিত সমস্যা রয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সড়কে থাকা ট্রাফিক পুলিশের ৩১ শতাংশ এই সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের ‘বাংলাদেশের রাজপথে শব্দদূষণ এবং শব্দদূষণের কারণে রাজপথে কর্মরত পেশাজীবীদের শ্রবণ সমস্যা’ নিয়ে করা এক গবেষণা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং সিলেট সিটি করপোরেশনে গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই গবেষণা জরিপ চালানো হয়। জরিপের আওতায় এসব এলাকার শব্দদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে। এ ছাড়া সড়কে কর্মরত ৬৪৭ জন পেশাজীবীর শ্রবণশক্তি পরিমাপ করা হয়েছে। গবেষণা জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, রিকশাচালক এবং ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা চালক, ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ দোকানদার, ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বাস-ট্রাক চালক, ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাইভেটকারচালক এবং ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ শব্দদূষণের শিকার। এ ছাড়া সিলেটে ৩১ শতাংশ, ঢাকায় ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৪ শতাংশ পেশাজীবী শব্দদূষণে ভুগছেন।

জরিপে বলা হয়েছে, ডিএনসিসি এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৯৬ দশমিক ৩ ডেসিবল। এ ছাড়া এসসিসিতে ৮৯ দশমিক ৯ ডেসিবল, সিসিসিতে ৯০ দশমিক ৩ শতাংশ, আরসিসিতে ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ডিএসসিসি এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়াদের প্রতি চারজনে একজন কানে কম শোনার সমস্যায় ভুগছেন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রমের পরিচালক ডা. নুরুল হুদা নাঈম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শব্দদূষণে শ্রবণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে বধির হচ্ছে মানুষ। যারা জন্মগতভাবে কানে শোনে না তারা কথাও বলতে পারে না। বধিরতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যাবে সচেতনতার মাধ্যমে। জন্মবধির ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ, শব্দদূষণ, আঘাত এবং বয়সজনিত কারণে হয়ে থাকে। এ ছাড়া কিছু ওষুধ (অটোটক্সিক ড্রাগস) ডায়াবেটিস টিউবারকিউলোসিসের কারণেও বধিরতা আসতে পারে। ন্যাশনাল প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সিস্টেমে ‘ইউনিভার্সাল হিয়ারিং কেয়ার’ পদ্ধতি চালু করলে অনেকাংশে বধিরতা রোধ করা সম্ভব। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা বহু জন্মবধির শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।’ শব্দদূষণ ডেকে আনছে নানা রোগ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস)-এর ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক ও রেজিস্ট্রার ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেছেন, শিশুদের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। কারণ, তাদের মস্তিষ্ক গঠনের পথে থাকে। শব্দদূষণ এই গঠন বাধাগ্রস্ত করে। শিশুর শেখার ক্ষমতা কমে যায়। কথা বলতে দেরি হয়। আচরণেও প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া শব্দদূষণ বড়দের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। শব্দদূষণের কারণে মানুষ অবসাদে ভোগে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সহিংসতার প্রবণতা বাড়ে। শব্দদূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে; নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দদূষণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এসবের কোনো কার্যকারিতা নেই।

নানা রোগে আক্রান্ত বাড়ছে

ঝুঁকিতে ঢাকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ

চারজনের মধ্যে একজন কানে কম শোনে

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর