শিরোনাম
বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই

♦ লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহন, রেষারেষি থামছে না ♦ ভাড়া আদায় নিয়ে তর্ক মারামারি প্রতিদিন

হাসান ইমন

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই

রাজধানীর সড়কে ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলাচল অব্যাহত রয়েছে। জীর্ণ বাসেই চলছে যাত্রী পরিবহন। অধিকাংশের উঠে গেছে রং, নেই লুকিং গ্লাস। পেছনের গ্লাসও ভাঙা, ধুলা-ময়লা যেন নিত্যসঙ্গী আসনগুলোর। ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনে চলাচল যেমন বিপজ্জনক তেমনি এসব লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি নগরীর সৌন্দর্য হানিও করছে। বিভিন্ন সময়ে এসব বাস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও রাস্তা থেকে সে সব বাস সরেনি। যাত্রীরা বলছেন, দেশের রাজধানী শহরে এমন বাস কোনোভাবেই চলতে পারে না। গত কদিনে রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরে সরেজমিনে এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস, এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িতেও একই অবস্থা। এসব জীর্ণ বাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ এই পরিস্থিতি স্বীকার করে বলেছেন, ঢাকার রাস্তায় লক্কড়-ঝক্কড় বাস আছে। তবে আমাদের পক্ষ থেকে বিআরটিএ-কে বারবার বলছি এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে। লক্কড়-ঝক্কড়, রংবিহীন এবং রুট পারমিটবিহীন বাস সড়কে না থাকুক সেটা আমরা চাই।

যানবাহনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা শহরে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৯৮টি। এসবের মধ্যে শুধু বাসের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৯১৯টি। মিনিবাস ১০ হাজার ৪২টি। মাইক্রোবাস ৯২ হাজার ২০৫টি। নিয়ম অনুযায়ী, এসব গাড়িকে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার পর রাস্তায় চলাচলের জন্য লাইসেন্স দেওয়ার কথা। তবে বিআরটিএর তথ্যে যা-ই থাক, বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনো বাসের গ্লাস ভাঙা, কোনোটির লুকিং গ্লাসই নেই, কোনোটির সামনে ও পেছনের বাম্পার খোলা, কোনোটির জানালার কাচ অর্ধভাঙা হয়ে ঝুলছে, কোনো কোনোটির আবার বডি দুমড়ানো-মোচড়ানো। আবার কোনো কোনো গাড়ি ভাঙাচোরা না হলেও রাস্তায় চলাচলের সময় ঘষাঘষির কারণে দু-তিন মাসের মধ্যেই রং উঠে কদাকার। রাজধানীর মৌচাক মোড়ে যানজটে আটকে থাকা এরকম একাধিক বাস চোখে পড়েছে।

স্বাধীন পরিবহন (ব-১২০৮২১) বাসটি চলে মোহাম্মদপুর থেকে মগবাজার, রামপুরা হয়ে স্টাফ কোয়ার্টার। এই পরিবহনের অবস্থা খুবই নাজুক। বাসটির পিছনের গ্লাস নেই। একই সঙ্গে দুই পাশের অধিকাংশ জানালার গ্লাস নেই। ভিতরে পাখা লাগানো থাকলেও চলে না। লুকিং গ্লাস নেই। বাসের সিট, সিট কভার ও জানালার পর্দায় বালু আর বালু। যাত্রীরা বসলে কাপর নোংরা হয়ে যায়। আর সিট কভারগুলো অনেক পুরনো ও ছেঁড়া। এই বাসটি পুরাই লক্কড়-ঝক্কড়। একই অবস্থা রাজধানী পরিবহন নামের ঢাকা মেট্রো (ব-১৫৩২২৮) বাসটির। এটি চলে হেমায়েতপুর থেকে মিরপুর হয়ে স্টাফ কোয়ার্টার। এই বাসটির পিছনের গ্লাস ভাঙা, কয়েক টুকরা হয়ে ঝুলে আছে। যে কোনো সময়ে গ্লাস পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সামনের লুকিং গ্লাস নেই, বাসটির দুই পাশে রং উঠে গেছে। বাসের ভিতরে চারটি পাখা থাকলেও একটি নষ্ট। সিটগুলোতে প্রচুর বালু। সিটের কাপড়গুলো অনেক পুরনো ও অপরিষ্কার। শিকড় পরিবহনের (ব-১৪১৯৯৪) বাসটি চলে যাত্রাবাড়ী থেকে শাহবাগ হয়ে মিরপুর। এই বাসটির দুই পাশে জানালার গ্লাস ভাঙা। সিট অপরিষ্কার ও চারটি পাখার মধ্যে দুটি কোনোমতে চলে। এই বাসটির দুই পাশে রং উঠে যাওয়ায় শ্রীহীন দেখা যাচ্ছে। একই অবস্থা মতিঝিল থেকে মিরপুর রুটে চলা বিকল্প পরিবহন, অছিম পরিবহন (ব-১১৮২৭৭), স্বাধীন পরিবহনের ব-১১৯৬২৮, বৈশাখী পরিবহনের ব-১১২২২৩, ভিক্টর ক্লাসিকের ব-১২০৯১০ সিরিয়ালের বাসগুলোর। এ ছাড়া আবদুল্লাপুর টু যাত্রাবাড়ী রুটের অনাবিল, তুরাগ পরিবহন, গাবতলী টু যাত্রাবাড়ী এবং গাবতলী টু সদরঘাট রুটের অধিকাংশ কোম্পানির বেশির ভাগ গাড়িই লক্কড়-ঝক্কড়।

ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত টাকা দিয়ে তবেই তারা এসব গাড়ি চালাচ্ছেন। প্রতি বছর যখন বিআরটিএর অভিযান জোরদার হয় তখন এসব গাড়ি ঢাকার আশপাশে পাঠানো হয়। অভিযান গতি হারানোর পর এগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে প্রবেশ করে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাইফুল ইসলাম নিয়মিত স্বাধীন-তরঙ্গ বাসে ত্রিমোহনী থেকে মৌচাকে যাতায়াত করেন। প্রতিবেদককে সাইফুল বলেন, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু গণপরিবহনের চিত্র পরিবর্তন হয়নি। বরং উল্টো পরিবহনের মান আরও খারাপ হয়েছে। শতকরা ৭০ ভাগ গণপরিবহনের ঘষাঘষির কারণে রং নেই এবং লক্কড়-ঝক্কড়। কোনোটিতে পাখা নষ্ট, সিট ভাঙা, কোনোটিতে আবার গ্লাস নেই। একটা দেশের রাজধানীর গণপরিবহনের চিত্র এমন তা মানতে পারছি না।

জহির নামের অছিম পরিবহনের এক চালক বলেন, ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে মালিকপক্ষের ‘চুক্তি’ (বোঝাপড়া) আছে। অভিযানের সময় ছাড়া গাড়ি ধরলে ছেড়ে দেয়। কারণ ট্রাফিক পুলিশকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয় মালিক। শাহেদ নামের সুপ্রভাত পরিবহনের এক চালক বলেন, গাড়ির ফিটনেসের জন্য মাঝে মাঝে ধরলে কিছু টাকা দিলে ছেড়ে দেয়। টাকা না দিলে অবশ্য বিভিন্ন ধারায় মামলা দিয়ে দেয়।

এদিকে বাস শ্রমিকদের খামখেয়ালিপনায় ঢাকার সড়কে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা। চলছে নৈরাজ্য। মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি। বেপরোয়া হেলপার থেকে চালক। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। ফলাফল সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায়ই নগরীর প্রতিটি সড়কে সর্বোচ্চ গতিতে ওভারটেকিং করছে বাস, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার। পুরো সড়ক দখলে নিয়ে গণপরিবহন চালাচ্ছেন তারা। বিনা প্রয়োজনে পেছনের বাসগুলোকে আটকাতে ঘন ঘন লেন বদলানো হয়। ফলে তাদের এই রেষারেষিতে সড়কে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। একই সঙ্গে ফিটনেসবিহীন বাস ও রুট পারমিটবিহীন বাসের আধিক্য রয়েছে সড়কে। দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মাঝে মধ্যে অভিযান দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। রাজধানীতে ২৫৮টি রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করলেও বিআরটিএর অভিযান চলে দু-একটি স্থানে। ফলে অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে অভিযুক্ত গণপরিবহন।

এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাস মালিকরা সবাই সমান নয়। কেউ কথা শুনে আবার কেউ কথা শুনে না। মালিকদের বলা হয়েছে লক্কড়-ঝক্কড় ও রং উঠানো বাস সড়কে না নামানোর জন্য। তারপরেও কিছু মালিক অতি লোভে সড়কে বাস নামাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে বিআরটিএকে বলেছি। এখন বিআরটিএ ব্যবস্থা নিলে হয়।

জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লক্কড়-ঝক্কড় বাস, রুট পারমিটবিহীন বাস, ফিটনেসবিহীন বাসের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে কিছুদিন ম্যাজিস্ট্রেট কম থাকায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে নতুন তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট যোগদান করেছে। এখন থেকে নিয়মিত অভিযান চলবে। তিনি বলেন, লক্কড়-ঝক্কড় বাস সড়কে না নামাতে পরিবহন মালিকদের বলা হয়েছে। রং করে এবং গাড়ি সার্ভিসিং করে নামাতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাসের চালকরা কে কার আগে যাবে এমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ জন্য বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। এগুলো বন্ধে পরিবহন মালিকদের বিভিন্ন সময় চিঠি দিলেও কোনো সুরহা হয়নি। তবে এগুলোর মূল কারণ হলো বাস মালিকরা চালকদের চুক্তিতে গাড়ি দেয়। এতে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এগুলো আমরা চালকদেরকে নিয়োগপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার জন্য মালিক পক্ষকে চিঠি দিয়েছি। চালকদের বেতনের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হলে তারা আর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর