রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি!

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি!

কলাগাছ এখন আর ফেলনা নয়। এত দিন কলাগাছের তন্তু থেকে সুতা বানানো হতো। আর এবার সেই সুতা দিয়ে বানানো হলো শাড়ি। এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁত্ত গ্রামের ভানুবিল এলাকার রাধাবতী দেবী। বান্দরবান জেলা প্রশাসকের অনুরোধে প্রথম চেষ্টাতেই তিনি সফল হয়েছেন। মাত্র আট দিনে একটি শাড়ি বুনে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। নিজেও হয়েছেন উৎফুল্ল। এই শাড়ি বানানোর জন্য তিনি কমলগঞ্জ থেকে বান্দরবান যান। বান্দরবান জেলা প্রশাসক তাকে এই শাড়ি বুননের জন্য নিয়ে যান। আগে কখনোই বাংলাদেশে কলা গাছের সুতা হতে শাড়ি তৈরি হয়েছে- এমনটি শোনা যায়নি। তবে ভারতে কলা গাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরি হয়। জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, এমনও হতে পারে এটাই দেশের প্রথম কলা গাছের বাকলের সুতা থেকে তৈরিকৃত শাড়ি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কলা গাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরি হওয়ায় তাঁত শিল্পে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। এখন এটিকে বাণিজ্যিক করতে গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া বান্দরবান জেলায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আবার জেগে উঠবে জেলার তাঁত শিল্প। জেলা প্রশাসক জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে কলা চাষ হয়। স্থানীয়ভাবে এটি ‘বাংলা কলা’ নামে পরিচিত। তিনি ২০২১ সালে এ জেলায় যোগদানের পর এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে এই ফেলে দেওয়া কলা গাছের বাকল থেকে সুতা তৈরির পাইলট প্রকল্প হাতে নেন। এই প্রকল্পে সহায়ক হিসেবে ছিল বেসরকারি সংস্থা ওয়াল্ডভিশন, গ্রাউস ও উদ্দীপন। প্রথম দিকে উৎপাদিত এই সুতা তাঁতিরা ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে দিতেন। এতে তাঁতিরা খুব একটা লাভবান হতেন না। তাই ২০২২ সালে স্থানীয় মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সুতা দিয়ে হস্তশিল্প পণ্য বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঢাকা থেকে প্রশিক্ষক এনে কলা গাছের সুতা দিয়ে হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরির ওপর মহিলাদের আরও ভালো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে ভালোই ফল হয়। এখন উৎপাদিত শতরঞ্জি, ব্যাগ, জুতা, শোপিস, টেবিল ম্যাট, প্লান্টার বক্স, কলমদানি, ফাইল ফোল্ডার হস্তশিল্পজাত পণ্য নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের ব্র্যান্ডিং বান্দরবান শপসহ স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দোকান ও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পরে জেলা প্রশাসক এ কাজকে জেলার অন্যান্য উপজেলায় ছড়িয়ে দেন। ওই বছরের শেষের দিকে জেলা প্রশাসক মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে সঙ্গে নিয়ে রাধাবতী দেবীর মাধ্যমে কাপড় তৈরির উদ্যোগ নেন। প্রথমে কলা গাছের সুতা দিয়ে যে কাপড় তৈরি করা হয় তা দিয়ে ফাইল ফোল্ডার বানানো হয়। এই কাপড় তৈরির সফলতাই শাড়ি তৈরির চিন্তার জন্ম দেয় জেলা প্রশাসকের মনে। তিনি জানান, সেই চিন্তা থেকেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে রাধাবতী দেবীকে বান্দরবান নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেখানে স্থানীয় মহিলাদের ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেন। মনিপুরীরা যে তাঁতে শাড়ি বুনন করেন ওখানেও সেই তাঁত বসানো হয়। পরে চলতি মার্চ মাসে রাধাবতী দেবী সেই তাঁতে কলা গাছের সুতা দিয়ে শাড়ি বুনন করেন। রাধাবতী দেবী এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। এখন ভালো লাগছে। আমিই প্রথম কলা গাছের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি করেছি। একটি শাড়ি বুনতে আট দিন সময় লেগেছে। সুতা লেগেছে পৌনে এক কেজি। একটি শাড়ির তৈরিতে খরচ পড়বে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, যখন আরও কম সময়ে এই শাড়ি বানানো যাবে তখন উৎপাদন খরচ আরও কমে আসবে। বান্দরবান জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপপরিচালক আতিয়া চৌধুরী বলেন, আমাদের একটি দীর্ঘ যাত্রা সফল হলো। একটি কলা গাছ থেকে ২০০ গ্রাম সুতা হয়। সেই হিসাবে পাঁচটি কলা গাছ থেকে ১ কেজি সুতা হয়। কলা গাছের সুতা দিয়ে শাড়ি বানাতে পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হব। কারণ এটা সম্পূর্ণ আমাদের দেশি সুতা। এখন আমাদের টেক্সটাইল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে এই সুতা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। তাহলে আমরা জানতে পারব কীভাবে সুতাটাকে আরও মোলায়েম করা যাবে। তন্তুটাকে কীভাবে আরও উন্নত করা যাবে। কীভাবে সুতা জোড়া লাগানো যাবে। কী করলে সুতার দীর্ঘস্থায়িত্বতা বাড়াবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর