কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কম্পিউটার সরবরাহ সংক্রান্ত টেন্ডারে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) এর মতে, এ অনিয়মের ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫০ টাকা।
প্রকিউরমেন্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, টেন্ডারের দরপত্র মূল্যায়নে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়নি। এখন এই আর্থিক ক্ষতির দায় সংশ্লিষ্ট কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের নিজেদের বহন করতে হবে।
জানা যায়, ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি) প্ল্যাটফর্মে টেন্ডার নং ১০৫৪১৫৬ থ এর মাধ্যমে কম্পিউটার সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ টেন্ডারে অংশ নেয় সাতটি প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে ছিল ওয়াল্টন ডিজি-টেক, সফট টেক, স্মার্ট টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেড, ক্রিয়েচার কম্পিউটারস ও গ্লোবাল ব্র্যান্ডস। সবচেয়ে কম দর (৪৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৫০ টাকা) দেওয়া সত্ত্বেও ওয়াল্টনকে টেন্ডার না দিয়ে তাদের তুলনায় উচ্চ দরদাতা স্মার্ট টেকনোলজিকে (৫৬ লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ টাকা) এ কাজ দেওয়া হয়।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এর ৪৮ (২) ধারা অনুযায়ী, সর্বনিম্ন যোগ্য দরদাতাকে টেন্ডার প্রদান করতে হবে।
কিন্তু ওই টেন্ডারের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি। এ বিষয়ে ওয়াল্টন গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর ৫৬ ধারা অনুযায়ী আপত্তি জানায়।
পরে ২১ এপ্রিল ‘রিভিউ প্যানেল-৩থ জানায়, টেন্ডার মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা ছিল না এবং প্রক্রিয়াটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তা ছাড়া মূল্যায়ন কমিটিতে কোনো বাইরের সদস্য না রাখায় বিপিপিএ অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে এই বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়।
যেহেতু ইতোমধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, তাই রিভিউ প্যানেল ওয়াল্টনকে ক্ষতিপূরণ দাবি করার অনুমতির পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা জামানত ফেরতের নির্দেশ দিয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়াল্টন ডিজি-টেকের চিফ বিজনেস অফিসার ও ওয়াল্টনের পক্ষে অভিযোগকারী তৌহিদুর রহমান রাদ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ সংবিধানের নীতিমালা অনুযায়ী সিপিটিইউ বরাবর অভিযোগ দিই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো জবাব না পাওয়ায় অটোমেটিক্যালি সিপিটিই্উ এর সর্বোচ্চ আইন অনুযায়ী চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে একটি আদালত গঠন করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সেখানে ওয়াল্টন ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডকুমেন্টস দাখিল করা হয়। পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে ১০ লাখ টাকার মতো জরিমানা করা হয়েছে। সামনেও আমরা নিয়ম অনুযায়ী আগাবো। আমাদের ইন্টারনাল সব কাজ চালু আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের আইন, সময়সীমা অনুযায়ী আমাদের লিগ্যাল টিম কাজ করছে।’
তবে এ ঘটনায় কুবির টেন্ডার প্রদান সংক্রান্ত ‘কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি’ ও ‘দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি’র সদস্যরা এক অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় সারেন।
‘কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি’তে আহ্বায়ক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও আইসিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাইফুর রহমান এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ।
এ ছাড়া দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান, সদস্য হিসেবে ছিলেন আইসিটি সেলের প্রোগ্রামার এ. এম. এম. সাইদুর রশিদ। এ ছাড়া এই টেন্ডারের প্রকিউরমেন্ট এনটিটি হিসেবে ছিলেন আইসিটি সেলের প্রধান মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি দপ্তরের প্রধান ও টেন্ডারের প্রকিউরমেন্ট এনটিটি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি আসলে সিপিটিইউ এর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত না। আমি টেন্ডারের সঙ্গে থেকে থেকে, দেখে শিখেছি। তবে কম্পিউটার বা এই সংক্রান্ত ক্ষেত্রে একটা টিইসি (কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি) থাকে। আমরা যে স্পেসিফিকেশন দিয়েছি এবং তারা যে স্পেসিফিকেশন টেন্ডারে উল্লেখ করছে এই ব্যাপারটা মূল্যায়ন করেছে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তারা ৭টা প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়াল্টনসহ আরো দুইটা প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি ত্রুটি দেখিয়ে স্কিপ করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাকী ৪ প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা স্মার্ট টেককে কাজ দিয়েছি। পরে ওয়াল্টন আমাদের কাছে আসে তখন তাদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত না জানার কথা বলি। আমরা তাদের বলি, আমরা যেটা চাচ্ছি আপনাদের প্রোডাক্ট যদি সমমানের হয় তাহলে সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটা সেমিনার টাইপ কিছু করে সবাইকে ধারণা দিতে। পরে সিপিটিইউ থেকে রায় আসলে ভিসি স্যার আমাকে ডেকে পাঠান এবং ওইখানে লিখা ছিল যে এটার দায় কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ওপর বর্তায়।’
এ ব্যাপারে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের তো টেকনিক্যাল বিষয়গুলো দেখার রাইটস আছে। আমাদের কাছে মূল্য কিংবা অন্যকিছু দেখার বিষয় থাকে না। আমরা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো দেখেই পাঠিয়ে দিই। এরপর সবকিছু ইভ্যালুয়েশন (দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি) কমিটি দেখে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেসিফিকেশন কমিটি থাকে এবং কম্পানির স্পেসিফিকেশন থাকে। সেখানে টেন্ডারের মূল্য জানার উপায় থাকে না। আমরা না জানি প্রাইস, না জানি অন্য কিছু। তাহলে আমাদের ওপর কিভাবে দায় আসে? এটা তারাই (দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি) ভালো বলতে পারবে।’
তবে নিজেদের অনভিজ্ঞতার কথা স্বীকার করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পরেই এগুলোর কাজ শুরু হয়। আমরা তো এক্সপার্ট না, নতুন। টেকনিক্যাল কমিটি পর্যালোচনা করার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এরপর ওয়াল্টন আমাদের আর কিছু জানায়নি। তারা আমাদের কিছু জানালে এর প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের বক্তব্য দিব। আপিলের সুযোগ থাকলে করব। তবে যে সমস্যাগুলো হয়েছে সামনের দিনে হবে না আশা করি। এক্সপার্টদের নিয়েই পর্যালোচনা করে এই কাজগুলো করা হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী লেখা ছিল যে ইন্টারন্যাশনালি রেপুটেটেড প্রতিষ্ঠান। এখন ওয়াল্টন দেশীয় কম্পানি বলে বাদ দিয়েছে, আবার ওয়াল্টন দাবি করেছে তারা ইন্টারন্যাশনালি রেপুটেটেড। এখন যারা এই কাজ করেছে, এই ৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পুরোটা তাদের দিতে হবে। রায় হয়ে গেছে। তিন জন মনে হয় এই কমিটির সদস্য। এখন এই টাকা তাদের পকেট থেকেই দিতে হবে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো টাকা দিবে না।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ