বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

নকল প্রসাধনীতে সর্বনাশ

♦ সক্রিয় ভেজালকারীরা ♦ বেশি নকল হচ্ছে বিউটিফিকেশন পণ্য ♦ তৎপর প্রশাসনও ♦ বাড়ানো হয় জরিমানার অর্থ

জিন্নাতুন নূর

নকল প্রসাধনীতে সর্বনাশ

‘স্ক্রিন সাইন’ নামের রং ফর্সাকারী একটি ক্রিম মৌলভীবাজারের প্রসাধনীর দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। এটি ভারতীয় পণ্য কিন্তু অভিযানে এর আমদানিকারকের কোনো তথ্য ভেজাল পরিচালনাকারী টিম ক্রিমটির গায়ে পায়নি। পণ্যটি অবৈধভাবে দেশে তৈরি করে তা বাজারজাত করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হাইড্রোকুইনন নামক নিষিদ্ধ পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) আইনে প্রসাধনীতে এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় প্রসাধনীর বাজার থেকে এখন এই ক্ষতিকর ক্রিমটি প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি রাজধানীর মৌলভীবাজারে ভোক্তা অধিদফতরের একটি দল আগে থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রসাধনীতে হাইড্রোকুইনন নামক নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তদারকি অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সে সময় অভিযান পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।

ফলে একদিকে যেমন দেশের ভেজাল প্রসাধনীর ব্যবসায়ীরা সরব আছেন। তাদের আটকাতে বসে নেই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও। ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে আগের চেয়ে যেমন জরিমানা বেশি করা হচ্ছে একইভাবে বন্ধ করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানও। প্রয়োজনে করা হচ্ছে মামলা।

ডলার সংকটের কারণে নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর ওপর এখন শুল্ক আরোপ বেশি। এ সুযোগে ভেজাল প্রসাধনীর ব্যবসায়ীরা ভেজাল পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ নিচ্ছেন। তারা ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়ার চেষ্টা করছে। এর বিউটিফিকেশনের পণ্যগুলোই সবচেয়ে বেশি নকল তৈরি করা হচ্ছে। এর বাইরে পশ আইটেমগুলোও নকল তৈরি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রসাধনী পণ্যের মোড়কে আমদানিকারকের তথ্য ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বিক্রেতারা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো লাগিয়ে রাখছেন। এতে পণ্য ভেজাল হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ছাড়া পণ্যের মোড়কে উপাদান, পরিমাণ, ব্যবহারবিধি, উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ করা হয় না। ব্যবসায়ীরা বিদেশি পণ্য নকল করে দেশের অভ্যন্তরে তৈরি করে বিদেশি পণ্য হিসেবে বিক্রয় করছে। বাজারে বিএসটিআই-এর অনুমোদনহীন ফেস ক্রিম, রং ফর্সাকারী ক্রিমসহ অন্য প্রসাধনী বিক্রি করা হচ্ছে। মুখের ক্রিমে রাসায়সিক পদার্থ হাইড্রোকুইনান ব্যবহারে বিধিনিষেধ থাকলেও অনেক ক্রিমে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে এরই মধ্যে বাজারে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসায়ীরা মোড়কজাতকরণ বিধিমালা অনুসরণ করছেন না। পণ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর প্রসাধনীর দোকানগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশি পণ্যে আমদানিকারকের স্টিকার ব্যবহার করা হচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ী আসল না নকল পণ্য বিক্রি করছেন তা জানা যাচ্ছে না। আবার স্টিকার না থাকায় বিক্রেতা খেয়ালখুশিমতো স্টিকার লাগিয়ে ক্রেতার কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন। বিক্রেতারা বিদেশি পণ্যের নামে যে পণ্য বিক্রি করছেন তার অধিকাংশ অবৈধ। এর আমদানিকারকের কোনো তথ্য তারা দিতে পারে না। অভিযান পরিচালনা করা হলে তারা জানান, তাদের কাছে এসে একটি সিন্ডিকেট এসব পণ্য দিয়ে যায়। এর মধ্যে অনেক আবার মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলোতে বিএসটিআই-এর কোনো সিলও নেই। আবার অনলাইনেও এখন বিভিন্ন নাইট ক্রিম, সিরাম, সুদিং জেলসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে। এগুলোর মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কিন্তু যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভিন্ন পেজ থেকে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলো ভোক্তার ক্ষতি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। তাদের মতে, অনলাইনে যারা পণ্য বিক্রি করেন তারা অনেক সময় আমদানিকারক থেকে পণ্য নেন না। এক্ষেত্রে পণ্য ভেজাল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মৌলভীবাজারের বিভিন্ন বিল্ডিং-এ ভেজাল ও নকল প্রসাধানী তৈরি করা হয়। শিগগিরই মৌলভীবাজাওে ভেজাল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে বড় অপারেশন পরিচালনা করা হবে। এর পাশাপাশি ঢাকার অভিজাত এলাকার বিভিন্ন শপিং মলগুলোতে যে প্রসাধনী পণ্য আছে তা আমরা পরীক্ষা করছি। আমদানিকারক ছাড়া কেউ পণ্য এলে তাদের আইনের আওতায় এনে জরিমানা করছি। অভিযানে আগের চেয়ে এখন জরিমানার অর্থের পরিমাণও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বড় যে প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য নকল করা হচ্ছে তারাও আমাদের সে তথ্য জানাচ্ছেন। এবার প্রয়োজনে আমরা ভেজাল পণ্য পেলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ করে দিচ্ছি। একইসঙ্গে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রির দায়ে এবার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করারও প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি জানান, দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে মানসম্মত পণ্য তৈরির সুনাম অর্জন করেছে। ভেজাল এড়াতে আমরা ব্যবহারকারী এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করছি।

এরই মধ্যে ভেজাল প্রসাধনী পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান। তিনি জানান, কোনো মার্কেটে নকল পণ্য ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট মার্কেটকে দায়ী করা হবে এবং বাজার সমিতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে মানহীন ও নকল কসমেটিকস বাজারজাত করতে সংসদে বিল তোলা হয়েছে। বিদ্যমান ওষুধ আইনে কসমেটিকস শব্দটি যুক্ত করে ‘ওষুধ ও কসমেটিকস’ বিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কসমেটিকসের ব্যবসা করতে ঔষধ প্রশাসন থেকে লাইন্সেস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর