বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

রেলের জলাধারে হচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেল

শামীম আহমেদ

রেলের জলাধারে হচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেল

দুই বছর আগে ঢাকার কুড়িলে রেলের ‘জলাধার’ ভরাট করে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ শুরু করেছিল মিলেনিয়াম হোল্ডিংস লিমিটেড। এতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কায় প্রতিবাদে নামেন স্থানীয়রা। উচ্চ আদালতে রিট করেন। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা উত্তরের মেয়রের উপস্থিতিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় নির্মাণাধীন হোটেলের সাইনবোর্ডসহ অস্থায়ী স্থাপনা। ১৪ ফেব্রুয়ারি জায়গাটিতে হোটেল নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেন হাই কোর্ট। আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলেও হোটেলের নতুন সাইনবোর্ড বসিয়ে দুই মাস ধরে স্থানটিতে চলছে মাটি ভরাট কাজ। তবে কে বা কারা এ কাজ করছে তার উত্তর নেই রেলওয়ে বা মিলেনিয়াম হোল্ডিংসের কাছে! এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর গত ১৭ এপ্রিল উধাও হয়ে যায় সাইনবোর্ডটি। তবে ঈদের বন্ধের মধ্যেও জায়গাটিতে ফেলা হয়েছে নতুন মাটি। এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল।

সরেজমিনে দেখা যায়, হোটেল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ত্রিকোণাকৃতি ওই জলাধারের দুই দিকে কুড়িল ফ্লাইওভার। একদিকে এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে। জমি লাগোয়া ৩০০ ফুট এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থল। ঢাকা থেকে সারা দেশের রেলসংযোগ চলে গেছে জমিটি ঘেঁষে। সেখানে চলছে রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নির্মাণের কাজ। চলতি এপ্রিল জুড়েই ওই স্থান দিয়ে যাতায়াতের সময় হোটেলের জন্য নির্ধারিত জমিতে মাটি ভরাট করতে দেখা গেছে। ১৬ এপ্রিল দুপুরে দেখা যায়, জমিটির পশ্চিম পাশে এক্সাভেটর দিয়ে মাটি কেটে চলছে রেলের কাজ। পুব দিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টিনের বেড়ার বাইরে স্তূপ করা মাটি আরেকটি এক্সাভেটর দিয়ে সমান করা হচ্ছে। পুরো জায়গাতেই বিচ্ছিন্নভাবে ফেলা হয়েছে নতুন মাটি। দক্ষিণ দিকে ফাইভ স্টার হোটেলের সাইনবোর্ড, নিচে লেখা ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে’। মাটি ভরাট প্রসঙ্গে এক্সাভেটর চালকের কাছে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিলেনিয়াম হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আইনকানুন মেনে ব্যবসা করি। আদালতের স্থগিতাদেশের পর আমাদের সব কাজ বন্ধ রয়েছে। উল্টো বেআইনিভাবে আমাদের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়েছিল। আমরা আর সাইনবোর্ড লাগাইনি। জায়গা দিতে না পারলে চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ চাইব। গত ১০ বছরে হোটেল প্রকল্পের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘স্থগিতাদেশ থাকায় রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের কাজও বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু তাদের বিদেশি ঠিকাদার মানতে চাইছেন না। তাই রেল কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কাজ বন্ধ। এখানে রেলের দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। সেটা তো রেলের ব্যাপার। আমাদের কোনো আইনি দুর্বলতা নেই।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী মহাপরিচালক (অবকাঠামো) শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মেয়র সাহেব ওখানে জলাধার করতে চাইছেন। মনে হয় না পারবেন। দুই দিন আগে-পরে ওই জায়গা ঠিকই দখল হবে, ভরাট হবে। আগে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ভুল করে ওই জমিতে গর্ত করেছিল। মিলেনিয়াম হোল্ডিংস থেকে অভিযোগ পেয়ে আমরা তাদের চিঠি দিয়ে নিষেধ করেছি। হোটেলের জন্য বরাদ্দ জায়গায় এখন কোনো কাজ চলার কথা না।’

মাটি ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এ এইচ এম সাখাওয়াত আকতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কুড়িলে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ। ওখানে আমাদের কোনো এক্সাভেটর এখন নেই।’ তিন পক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর ১৭ এপ্রিল ঘটনাস্থলে গিয়ে সাইনবোর্ডটি আর পাওয়া যায়নি, দেখা যায়নি এক্সাভেটরও। গতকাল ঘটনাস্থলে নতুন সাইনবোর্ড দেখা গেছে, তবে তাতে কিছুই লেখা নেই। এদিকে ঈদের ছুটির মধ্যেও জমির পুব পাশে স্তূপাকারে রাখা মাটির পরিমাণ বেড়েছে।

নতুন করে সাইনবোর্ড বসিয়ে মাটি ভরাট প্রসঙ্গে মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওই জমি ভরাট হলে নিকুঞ্জসহ বিমানবন্দর রোডে বর্ষার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নগরবাসীর স্বার্থে এখানে হোটেল করতে দেওয়া হবে না। সিটি করপোরেশনের আইন বিভাগ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’

এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, কুড়িল জায়গাটি একটি ট্রান্সপোর্ট হাব। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক, রেললাইন, মূল সড়ক সব এসে মিশেছে এখানে। জায়গাটি ফাইভ স্টার হোটেলের জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত না। নতুন করে রেললাইন সম্প্রসারণ বা অন্য কোনো যোগাযোগ অবকাঠামো করতে গেলেও হোটেলটি ভাঙতে হবে। আবার চারদিকে রেললাইনসহ বিভিন্ন যোগাযোগ অবকাঠামো থাকায় জায়গাটি পার্কের জন্যও উপযুক্ত না, তবে এখানে নান্দনিক জলাধার করা যায়। জায়গাটি আগে থেকেই জলাধার ও একটি ড্রেনেজ চ্যানেল। এ জমির ধরন পরিবর্তন করা বেআইনি। নগরীতে ১৫ শতাংশ জলাধার প্রয়োজন। আছে মাত্র ৫ শতাংশ। এভাবে জলাধার ভরাটের পরিবেশগত প্রভাব ভয়াবহ। জানা গেছে, ঢাকায় ‘হোটেল হিলটন’ নামে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের জন্য মিলেনিয়াম হোল্ডিং লিমিটেড ২০০৬ সালে রেলের জমি বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করে। বড় মগবাজারে ৪.১৬ একর রেলের জমি হোটেলের জন্য ৬০ বছর মেয়াদে লিজ দেয় মন্ত্রণালয়। হাতিরঝিল প্রকল্প শুরু হওয়ায় ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বাতিল করে দেয়। তখন রেলওয়ের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশন মামলা করে মিলেনিয়াম কর্তৃপক্ষ। আদালত রেলের বিকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী বিমানবন্দর এলাকায় ৮.৭৫ একর জমি হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকায় সেই জমি মিলেনিয়ামকে দিতে পারেনি রেল। পরে ২০১৮ সালে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় কোম্পানিটিকে ১.৮৪ একর জমি লিজ দেওয়া হয়। দেওয়া হয় জমির লাইসেন্স। কাজ শুরুর পর বাধে বিপত্তি। বর্ষাকালে আশপাশ এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য এ প্রকল্পকে দায়ী করে কুড়িল, কুড়াতলী ও খিলক্ষেতের অধিবাসীরা বিক্ষোভে নামেন। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি মেয়রের উপস্থিতিতে ফাইভ স্টার হোটেলের বিলবোর্ড অপসারণ করেন তারা। এদিকে রেলের পরবর্তী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) মামুনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা মিলেনিয়াম হোল্ডিংসকে লাইসেন্স দিয়েছি। এখানে অনেক মামলা আছে। উত্তর সিটি করপোরেশন কাজ করতে দিচ্ছে না। সামনে কী হবে এখনই বলা যাচ্ছে না। জায়গা বুঝিয়ে দিতে না পারলে টাকা দিয়ে দিতে হবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে স্ট্যান্ড নিয়ে এগোব।’

সর্বশেষ খবর