মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে মাঠ ও পার্ক

নাগরিক সুবিধা আরও কমছে, সিটির অধিকাংশ বিনোদন স্থান ইজারা, নানা স্থাপনা নির্মাণে কমছে জায়গা, ইজারার নামে গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে : নগর বিশেষজ্ঞ

হাসান ইমন

বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে মাঠ ও পার্ক

পার্কের মধ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা -রোহেত রাজীব

রাজধানীতে বসবাস করছে ২ কোটি মানুষ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার বা বিনোদনের জায়গা খুবই সীমিত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মাঠ ও পার্ক রয়েছে মাত্র ৫৩টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের ৩১টি ও ঢাকা উত্তরের ২২টি। এর বাইরে অনেক ওয়ার্ডে নেই পার্ক ও মাঠ। জনসংখ্যা অনুযায়ী বিনোদন স্থানের সংকটের মধ্যেও সংস্থা দুটি মাঠ ও পার্ক ইজারা দিচ্ছে, যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে নানা বাণিজ্যিক অবকাঠামো। এসব স্থাপনা নির্মাণের ফলে আরও কমছে পার্ক ও মাঠের জায়গা। এতে জনবহুল এই নগরীতে নাগরিক সুবিধা আরও কমছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইজারা দেওয়ার নামে পার্ক ও মাঠগুলো ক্লাব বা কোনো নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠীর হাতে চলে যাবে। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের নির্বিঘ্ন চলাচল আরও সীমিত হয়ে যাবে।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের একমাত্র স্বস্তির জায়গা শহীদ মতিউর পার্ক। এটি ইজারা দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। উন্মুক্ত পার্কটির চারদিকে দেয়াল দিয়ে ভিতরে বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি রাইড ও খাবারের দোকান। পার্কটিতে প্রবেশমূল্য নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। ইজারা দিয়ে টিকিট সিস্টেম করে পার্কটিতে জনসাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। একইভাবে বাহাদুর শাহ পার্কও ঢাকা দক্ষিণ সিটি ইজারা দিয়েছে। ইজারাদার সেখানে স্থায়ী অবকাঠামো ও দোকান নির্মাণ করেছেন। এতে পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের নির্মল বাতাস গ্রহণ, শরীরচর্চা ও হাঁটা-চলার সুযোগ ব্যাহত হচ্ছে। অথচ ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ এই পার্ক পুরান ঢাকাবাসীর স্বস্তির জায়গা। পাশাপাশি আশপাশের ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এটি ব্যবহার করেন। শুধু এই দুটি নয়, এর বাইরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আরও ১০টি খেলার মাঠ ও পার্ক ইজারা দিয়েছে। এর মধ্যে রসুলবাগ শিশুপার্কে কফি হাউস, বাসাবো খেলার মাঠে কফি হাউস ও ফুডকোর্ট, মতিঝিল পার্ক, মালিটোলা পার্ক, সিক্কাটুলি পার্ক, সিরাজউদ্দৌলা পার্ক, বংশাল পার্ক, আজিমপুর নগর পাঠাগারে রেস্টুরেন্ট ও কফি শপ, আবদুল আলীম মাঠে কফি হাউস ও ব্যয়ামাগার, যাত্রাবাড়ী শেখ রাসেল পার্কে ক্যাফেটেরিয়াসহ সবগুলোতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। এদিকে ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, নতুন নির্মিত ও সংস্কার করা পাঁচটি পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের জন্য প্রস্তাব আকারে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পার্ক ও মাঠগুলো হলো শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্ক (গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক), বনানী রোড নম্বর ২৭ পার্ক (কামাল আতাতুর্ক পার্ক), শহীদ যায়ান চৌধুরী মাঠ (চেয়ারম্যানবাড়ী খেলার মাঠ), বারিধারা পার্ক, বনানী ব্লক সি পার্ক। সংস্থাটির সূত্রে আরও জানা যায়, এসব মাঠ ও পার্কের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ডিএনসিসির একার পক্ষে সম্ভব নয়। লোকবল সংকট এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। অর্থনৈতিক বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছেন কর্মকর্তারা। সবকিছু ভেবে বাণিজ্যিক পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। পার্ক ও মাঠ রক্ষায় বিকল্প কোনো ভাবনা আপাতত নেই সংস্থাটির।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তকে মারাত্মক ভুল বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের নামে ঢাকার পার্ক ও মাঠগুলোয় বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থা দখল কায়েম করেছে। সাধারণ মানুষের প্রবেশে নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তারা। পরিকল্পনা, আইন ও ন্যায্যতার দৃষ্টিতে এগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হতে পারে এমন যে কোনো উদ্যোগই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এগুলো এলাকাবাসী ও সাধারণ মানুষের মাঠ। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় কাউন্সিলর এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে পার্ক ও মাঠ রক্ষায় একটি কমিটি করে দেবেন। সেই কমিটিই ঠিক করে দেবে এসব গণপরিসর রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার জন্য কী করতে হবে। তারা যদি মনে করে এসব রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান দরকার, তাহলে বিলবোর্ড-বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পার্কের পরিচালন ব্যয় মেটাতে আমরা ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। তবে এগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়া হবে না।’ তিনি বলেন, ইজারা দেওয়ার বিষয়ে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এই নীতিমালা তদারক করতে একটি কমিটি থাকবে। আর এই কমিটি নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালন ব্যয় মেটাতে পার্ক ও মাঠের ভিতর কী করা যায় সেই সিদ্ধান্ত নেবে। সে আলোকে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।

সর্বশেষ খবর