শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইতিহাসের সাক্ষী উজানী জমিদারবাড়ি

আমিনুল হাসান শাহীন, গোপালগঞ্জ

ইতিহাসের সাক্ষী উজানী জমিদারবাড়ি

মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলে যশোর থেকে রায় গোবিন্দ ও সুর নারায়ণ নামক দুই জমিদার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) মুকসুদপুরের উজানী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তারা তেলিহাটি পরগনা পত্তন নিয়ে শুরু করেন এলাকার জমিদারি প্রথা। সেই সুবাদে উজানীতে নির্মিত হয় বিভিন্ন কারুকার্যখচিত দ্বিতল-ত্রিতল বিশিষ্ট জমিদারদের বসতের জন্য দালানবাড়ি- যা বর্তমানে রাজবাড়ি নামে পরিচিত। সেই সঙ্গে জমিদাররা নির্মাণ করেন পাকা বৈঠকখানা, শান বাঁধানো ঘাট, টেরাকোটা সমাধি মঠ ও মন্দির। জমিদারদের সেইসব প্রাচীন ভাস্কর্যশিল্পের অনুপম নিদর্শন ধ্বংসের মুখোমুখি অবস্থায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব নিদর্শন এখানে আগত দর্শক পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এখন টিকে থাকা জমিদার সুর নারায়ণের প্রোপৌত্র প্রশান্ত রায় দর্শনার্থীদের কাছে বলে যান সেই জমিদারি আমলের রূপকথার ইতিহাস। তিনি জানান, অবিভক্ত ভারত বিভাগ ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর এখানকার জমিদাররা ভারতে চলে গেলেও তিনি পৈতৃক নিবাস ছেড়ে যাননি। জমিদাররা চলে গেলেও থেকে যায় তাদের স্মৃতিচিহ্নগুলো। সংস্কার আর সংরক্ষণের অভাবে সে চিহ্নগুলো এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ভেঙে পড়ছে প্রাচীরঘেরা দালানবাড়ি, মন্দির, মঠ ইত্যাদি। প্রাচীন ভাস্কর্যশিল্পের অনুপম টেরাকোটা শৈলীর নির্মিত জমিদারদের মঠটির ছাদ ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া গুপ্তধনের সন্ধানে খোঁড়াখুঁড়ি, ভাঙচুর করে কতিপয় লোকজন মঠটিকে বিকৃত করে ফেলেছে। এই মঠটি প্রায় ৩০ হাত মাটির নিচে দেবে গেছে। জমিদারবাড়ির সন্নিকটে কালীমন্দিরটিও ভগ্নদশায় পতিত। এই মন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অনেক আগেই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জমিদারবাড়ি-সংলগ্ন বিশাল দিঘিটিও দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার করা হয়নি। উজানীর অদূরে মহাটালী গ্রামে রয়েছে জমিদার আমলের আরও একটি প্রাচীন মন্দির ও ধর্মরায়ের বাড়িতে আছে বিশাল দিঘি। দীর্ঘদিন ধরে এগুলো কোনো সংস্কার না করায় ক্রমে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। প্রশান্ত রায়ের কাছ থেকে আরও জানা যায়, জমিদারদের ফেলে যাওয়া সম্পদের প্রায় ৭০ ভাগ জায়গা এলাকার কিছু প্রভাবশালী মহল ভয়ভীতি দেখিয়ে ছলচাতুরি করে জাল দলিল ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে।

বাংলা ১৩৫২ সালের ঝড়ে তহশিলের বিভিন্ন কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এই সুযোগে এলাকার ওই প্রভাবশালীরা জমিদারি সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ দলিল করে নেন।

যা ইসলাম কাঠি দলিল বাংলাদেশ আমলে বাতিল করা হয়। পুরনো স্মৃতিচারণ করে প্রশান্ত রায় বলেন, তৎকালীন চান্দা বিলসহ প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর এলাকা ছিল তাদের জমিদারি। আর এই জমিদারি এলাকার বিভিন্ন অংশে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা স্থাপনা, নিদর্শন। উজানীর ১৫ কি.মি. পূর্বে রাজৈর উপজেলার খালিয়াতেও রয়েছে অনুরূপ জমিদারবাড়ি, টেরাকোটার মন্দির, শানবাঁধানো ঘাট ইত্যাদি। উজানীর জমিদারবাড়ি, মন্দির, মঠের সঙ্গে খালিয়া জমিদারবাড়ির যথেষ্ট মিল রয়েছে। উজানীর জমিদারবাড়ির মতো খালিয়ার জমিদারবাড়ির নিদর্শনগুলোও বর্তমানে ধ্বংসের মুখে। এক সময়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উজানী ও খালিয়ার সঙ্গে পাকা সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলেও সংস্কার ঘটেনি ইতিহাস বিজড়িত এখানকার স্মৃতিচিহ্নগুলোর। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ উজানী ও খালিয়ার জমিদার আমলের নিদর্শনগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে এলে এখানেও গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। গোপালগঞ্জের কবি, সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, গোপালগঞ্জ জেলার ২২টি জমিদারির মধ্যে উজানী জমিদারদের জমিদারি ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তর। তারা অত্যন্ত প্রজাদরদি ছিলেন। ভোগবিলাসের চেয়ে জনসেবার দিকেই তাদের লক্ষ্য ছিল বেশি। তারা শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন। এ ছাড়া দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে আর্তপীড়িত মানুষের সেবা করেছেন। দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের খাদ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। প্রজাদের যে কোনো সমস্যার সমাধান করেছেন। অত্যাচার নির্যাতনের পরিবর্তে ভালাবাসা দিয়ে তারা প্রজাদের মন জয় করেছেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জমিদাররা সাধারণত কলকাতায় বসবাস করতেন। নায়েবরা কর বা খাজনা তুলে কলকাতায় পাঠাতেন। সেখানে বসেই পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বিলাসী জীবনযাপন করতেন। এই ক্ষেত্রে উজানীর জমিদাররা ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা উজানীতেই বসবাস করতেন। প্রজাদের হাসি, কান্না, দুঃখ বেদনার সাথী-ভাগী হতেন। প্রজাদের কল্যাণে কাজ করতেন। এই কারণে উজানীর জমিদারদের প্রতি বিল চান্দা এলাকার মানুষের শ্রদ্ধাবোধ এখনো বিদ্যমান। এই জমিদার বংশের অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে জানান দিতে জমিদারবাড়িটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। যাতে এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

সর্বশেষ খবর