বুধবার, ৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বরিশালে লড়াই হবে চতুর্মুখী

সিটি নির্বাচন

রাহাত খান, বরিশাল

বরিশালে লড়াই হবে চতুর্মুখী

বরিশালে বিএনপিবিহীন সিটি নির্বাচনে আপাত দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের জয় দেখছেন অনেকে। তবে এই সমীকরণ পাল্টেও যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী কিংবা বিএনপির প্রয়াত সাবেক মেয়র পুত্র কামরুল আহসান রূপণের মধ্যে যে কেউ শেষ হাসি হাসতে পারেন বলে হিসাব কষছেন বিশ্লেষকরা।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিগত চারটি নির্বাচনে দুবার জিতেছে বিএনপি। ২০০৩ সালের প্রথম নির্বাচনে বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার দলের দুজন বিদ্রোহী এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছেন যোজন ভোটের ব্যবধানে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরণ (প্রয়াত) মাত্র ৫০০ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এস সরফুদ্দিন সান্টুর সঙ্গে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণকে প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন বিএনপির আহসান হাবিব কামাল। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ প্রায় ৯০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যদিও ভোটের দিন সকালেই অনিয়মের অভিযোগে ভোট বর্জন করেছিলেন অপর প্রতিদ্বন্দ্বীরা।

এবারের চিত্র ভিন্ন। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর বরিশাল সিটি নির্বাচনও সুষ্ঠু সুন্দর হবে বলে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে নাগরিকদের মাঝে। এ জন্য নাগরিকদের মন জয় করে বিজয়ী হতে রাতদিন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন মেয়র প্রার্থীরা।

ভোটের মাঠে বিএনপি থাকলে সমীকরণ অনেকটা সহজ হয়ে যেত। বিএনপিবিহীন সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একতরফা সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। নতুন বরিশাল বিনির্মাণ এবং বরিশাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১২ জুন নৌকা বিজয়ী করার আহ্বান জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বরিশালের ভোটের মাঠে তেমন সুবিধা করতে পারছে না সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তবে সিটিতে জাপা প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের ব্যক্তিগত পরিচিতি এবং সমাজসেবামূলক কর্মকান্ড উঠে আসছে আলোচনায়। বরিশালকে উৎপাদনমুখী, ডিজিটাল এবং আইটি নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিটিতে ভোট চাইছেন তিনি। তার এই প্রতিশ্রুতি স্পর্শ করতে পারে তরুণ ভোটারদের।

এ নিয়ে দ্বিতীয় বার বরিশাল সিটি নির্বাচনে প্রার্থী দিল চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আগেরবার নামমাত্র প্রার্থী দিলেও এবার তারা জয়ের আশায় প্রার্থী দিয়েছে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির ও শায়খে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমকে। বরিশালকে শান্তিময় এবং শিক্ষার নগরী গড়তে ১২ জুনের নির্বাচনে দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে হাতপাখায় ভোট চাইছেন তিনি।

বরিশাল শহরে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির প্রয়াত সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালকে ক্যারিশমাটিক বলতেন অনেকে। ২০০৩ সালে বিদ্রোহী হিসেবে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ১৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল অংশগ্রহণ না করলেও স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে ২২ হাজার ভোট পেয়েছিলেন কামাল। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির আহসান হাবিব কামাল। এর আগে পৌরসভায়ও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বিএনপি এবারের সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক মেয়র কামাল পুত্র কামরুল আহসান রূপণ। নিজের তেমন পরিচিতি বা উল্লেখযোগ্য অর্জন না থাকলেও প্রয়াত বাবার নামের ওপর ভর করে নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন রূপণ। দিচ্ছেন বাবার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার প্রতিশ্রুতি। নির্বাচিত হতে পারলে রোদ-বৃষ্টি ঝড় সব সময় নগরবাসীর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তিনি। বিএনপির কোনো পদে না থাকলেও (এক সময় ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন) দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় গত ৩ জুন রূপণসহ বরিশালের ১৯ জনকে আজীবন বহিষ্কার করে বিএনপি। তবে এই বহিষ্কার নির্বাচনের মাঠে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি তার। বরিশাল সিটি নির্বাচনে অন্য মেয়র প্রার্থীরা হলেন- জাকের পার্টির মিজানুর রহমান বাচ্চু এবং দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী আলী হোসেন হাওলাদার ও আসাদুজ্জামান।

১২ জুন বিসিসির ১২৬টি কেন্দ্রে ভোট হবে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন।

প্রচারণায় প্রার্থীরা : ১২ জুনের নির্বাচনে নৌকা জয়যুক্ত হলে বরিশালের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত। এদিকে বরিশালকে উৎপাদনমুখী ও আইটি শহরে পরিণত করতে লাঙ্গলে ভোট চাইছেন জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস। শান্তিময় শিক্ষার নগরী গড়তে হাতপাখায় ভোট চাইছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী। অপরদিকে সরকার ও নির্বাচন কমিশন নগ্ন হস্তক্ষেপ না করলে জয়ের আশা করছেন সাবেক মেয়রপুত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ। জাকের পার্টির মিজানুর রহমান বাচ্চুও ভোট চাইছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত গতকাল বেলা ১২টার দিকে নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের গড়িয়ারপাড় এলাকায় গণসংযোগ করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিগত দিনে বরিশালে প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি। বিশেষ করে বর্ধিত এলাকা ছিল একেবারে অবহেলিত। সিটি নির্বাচনে নৌকা বিজয়ী হলে বরিশালের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা তার। বিরোধী প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে নৌকার প্রার্থী বলেন, আচরণবিধি দেখার জন্য নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। কোথাও বিচ্যুতি হলে সেটি দেখার দায়িত্ব তাদের। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হাজী মহসিন মার্কেট, নদীবন্দর ও সিটি মার্কেটে গণসংযোগ করেন। এ সময় তিনি বরিশালকে উৎপাদনমুখী আইটি শহরে পরিণত করার প্রতিশ্রুতির পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বরিশালের মানুষ এত দিন ছিল অবহেলিত ও নিগৃহীত। ভালোভাবে বাঁচার সংগ্রামে বরিশালবাসী এককাট্টা হয়েছে। ১২ জুন সুযোগ পেলে তারা লাঙ্গলে ভোট দিয়ে এর প্রমাণ দেবে।

এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কালিজিরা ও হরিণাফুলিয়া এলাকায় গণসংযোগ করেন। এ সময় সম্মিলিতভাবে শান্তিময় নিরাপদ নগরী গড়তে হাতপাখায় ভোট চান তিনি।

গণসংযোগকালে মুফতি ফয়জুল করীম সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচিত হতে পারলে বরিশালকে শান্তিময় ও শিক্ষার নগরী হিসেবে গড়ে তুলবেন, যেখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ভাসমান ভোটারদের ভোট পেতে তাদের কল্যাণেও নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

বিএনপির প্রয়াত মেয়রপুত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জিলা স্কুল মোড় থেকে সদর রোডের দুই পাশে গণসংযোগ করেন।

এ সময় রূপণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই জনগণের সারা পাচ্ছি। জনগণ ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।’ আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট টেবিলঘড়ি মার্কায় পড়বে বলে প্রত্যাশা তার। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন নগ্ন হস্তক্ষেপ না করলে টেবিলঘড়ি বিজয়ী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাচ্চু সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর আমতলা মোড় থেকে বান্দ রোড হয়ে চাঁদমারী পর্যন্ত গণসংযোগ করেন। এ সময় তিনি বরিশালের উন্নয়নে গোলাপ ফুল মার্কায় ভোট চান। অপর দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী আলী হোসেন হাওলাদার ও আসাদুজ্জামানের প্রচারণা দেখা যায়নি।

বরিশাল নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। ১২ জুন নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রে ভোট দেবেন তারা।

সর্বশেষ খবর