শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

শীতে দগ্ধ রোগীর ভিড় হাসপাতালে

রংপুরে দগ্ধ হয়ে চার নারীর মৃত্যু

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বাসাজুড়ে ছুটে বেড়ায় তিন বছরের মিরাজ হাসান। নরসিংদীর মাধবদীতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত সে। বাবা পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করেন। মা ইয়াসমিন আক্তার গৃহিণী। ঘরময় দৌড়ে বেড়ানো ছোট্ট মিরাজের হাসিমুখ ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বেডের পাশে চেয়ারে বসে ছিলেন ইয়াসমিন। ছেলের ক্যানুলা লাগানো ছোট্ট হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অবনত মুখে দোয়া পড়ছেন, চোখ দিয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। ইয়াসমিন আক্তার বলেন, দুপুরের রান্না শেষ করে ছেলেকে গোসল করানোর জন্য গ্যাসের চুলায় পানি গরম করেছেন। মিরাজ এসে বারবার দুষ্টুমি করছিল। তাকে অন্য ঘরে রেখে এসে বালতিতে গরম পানি ঢেলে পেছনে ঘুরে চুলা পরিষ্কার করছিলেন। এইটুকু সময়ের মধ্যেই দৌড়ে এসে গরম পানির বালতিতে হাত দিয়েছে মিরাজ। পানি ছিটে এসে লেগেছে বুকে-পেটেও। শুধু মিরাজ নয়, এরকম বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ পানি কিংবা খাবার গরম করতে গিয়ে গরম পানি পড়ে কিংবা চুলা থেকে আগুন লেগে আহত হয়েছেন। ঘটেছে মৃত্যুর ঘটনাও। দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা নারীরাও। এতে বিপদ আরও বাড়ছে। উত্তরবঙ্গ থেকে অনেক বয়স্ক মানুষ এসেছেন, যারা শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে কাপড়ে আগুন লেগে দগ্ধ হয়েছেন। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার এলাকার দিলজন বেগম (৫৫) গত ২১ জানুয়ারি খড়কুটা জ্বালিয়ে আগুন পোহানোর সময় কাপড়ে আগুন লেগে দগ্ধ হন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

শীত এলেই আগুনে পোড়া রোগীর ভিড় বাড়ে হাসপাতালে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ হাজার ৩২৬ জন। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭০৩ জন। হাতিয়া থেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এসেছেন রুনা আক্তার (৩৫)। ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুনা আক্তারের শরীরের ৩২ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার বাবা আবুল হাই বলেন, রাতের খাবারের জন্য ডাল গরম করতে গিয়েছিল রুনা। এ সময় শাড়ির নিচের অংশে চুলা থেকে আগুন লেগে যায়। আহত অবস্থায় হাতিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেলে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলা হয়। হাতিয়া থেকে লঞ্চ, ফেরি পার হয়ে ঢাকায় আসতে লেগেছে দুই দিন। বুধবার রওনা হয়ে এসে শুক্রবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। রংপুর থেকে নজরুল মৃধা জানান, শীতের হাত থেকে বাঁচতে আগুনের উত্তাপ নিতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রমেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত এক মাসে চার নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অগ্নিদগ্ধ হয়ে শতাধিক নারী-শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে ৪৬ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এবারের শীত মৌসুমে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের শরীরের ১০ থেকে ৬৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। গত এক মাসে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে দগ্ধ হয়ে তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকার আলেয়া বেগম (৬০), নগরীর তাজহাট এলাকার নাসরিন বেগম (৩৫), রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বাসিন্দা আমেনা বেগম (৬০) অগ্নিদগ্ধ হয়ে রমেক হাসপাতালে মারা যান। রমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে ৪৬ জন দগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শীতকালে প্রতি বছরই আগুনে দগ্ধ হয়ে কিংবা শরীরে গরম পানি পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর ভিড় বাড়ে। অনেকে আগুন পোহাতে গিয়ে কিংবা রান্না করতে গিয়ে দগ্ধ হন। শিশুদের গরম পানি মিশিয়ে গোসল করাতে গিয়ে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তাই শিশু, বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। গরম পানি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।’

সর্বশেষ খবর