গত কয়েক দিনের আন্দোলন-সংঘাতের কারণে ক্ষতি হয়েছে অর্থনীতির সব সেক্টরেই। আন্দোলন ও তৎপরবর্তী কারফিউর কারণে ১৬ থেকে ২৩ জুলাই এক সপ্তাহ দেশে যানবাহন ও কলকারখানার চাকা ঘোরেনি। কৃষি ছাড়া শিল্পের সব খাতেই উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। কৃষি উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও পরিবহন বন্ধ থাকায় কৃষক উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পায়নি। আবার সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ায় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্ধ ছিল ব্যাংকিং লেনদেন ও আর্থিক সেবা। কারফিউ জারির কারণে মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারেনি। ফলে অন্যান্য খাতের মতো পরিবহন ও নির্মাণ খাতেও ছিল স্থবিরতা। ফলে এটি অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই ক্ষত তৈরি করেছে।
আন্দোলন-সংঘাত ঘিরে সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনো নিরূপণ করা যায়নি। পরিপূর্ণভাবে নিরূপণ হয়নি রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। সীমিত পরিসরে খাতভিত্তিক কিছু হিসাব তুলে ধরছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী নেতাদের বরাত দিয়ে আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আন্দোলনের পাঁচ দিনে পোশাকসহ পাঁচ খাতে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে পোশাক খাতের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি জানান, নিরাপত্তার কারণে গত শনিবার থেকে সব গার্মেন্ট বন্ধ ছিল। সেই সঙ্গে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও প্রভাব পড়ে। ফলে প্রতিদিন এ খাতে ক্ষতি হয়েছে দেড় শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কারখানা বন্ধ থাকায় পোশাক খাতের ক্ষতি দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আন্দোলনে পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল পাঁচ দিন। সে হিসেবে গার্মেন্ট সেক্টরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রায়। পোশাক খাতের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে পরিবহন খাত। বিপুলসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলন ও পরবর্তী কারফিউর কারণে টানা এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল যানবাহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক দিন বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ থাকলে ক্ষতি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক সপ্তাহ যানবাহন বন্ধের কারণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। শুধু উৎপাদনমুখী খাতে স্থবিরতা ছিল তাই নয়, ডেটা সেন্টারে অগ্নিকান্ডের কারণে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। সংঘাতের লাগাম টানতে আগে থেকেই বন্ধ ছিল মোবাইল ইন্টারনেট সেবা। ফলে আমদানি-রপ্তানি থেকে শুরু করে বহির্বাণিজ্য পুরোদমে স্থবির হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ থাকায় দেশের ফ্রিল্যান্সিং খাত কোনো ধরনের কাজই করতে পারেনি। এতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কৃষিপণ্যনির্ভর ই-কমার্সও ক্ষতির মুখে পড়েছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় শুধু কল সেন্টারে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ ডলার আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স খাতে ক্ষতির পরিমাণ দৈনিক প্রায় ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের পর্যটন খাত। কক্সবাজারের হোটেল ও রিসোর্ট মালিকরা জানিয়েছেন, ব্যাপক সংঘাতের কারণে যানবাহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পর্যটক আটকে পড়েন। আবার যারা কক্সবাজারে আসার জন্য বুকিং দিয়েছিলেন, তারা বুকিং বাতিল করে দেন। একই সঙ্গে সারা দেশের হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ সেবাও বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ঝুঁকির কারণে অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সেবা বন্ধ রাখে। আন্দোলন, সংঘাত ও পরবর্তী কারফিউর কারণে বন্ধ ছিল দোকানপাট। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মোকামগুলো বন্ধ থাকায় সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বাজারব্যবস্থায়। একদিকে পণ্যের অভাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহর ও বাণিজ্যিক নগরীগুলোয় সবজি ও কাঁচা পণ্যের দাম বেড়ে যায়; অন্যদিকে কৃষক ও উৎপাদক শ্রেণি পণ্য বিক্রি করতে না পেরে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে উত্তরবঙ্গের হাঁড়িভাঙা আমের বাজার। এমনকি রাজধানীতে ডিম ও পোলট্রি মুরগির দাম বাড়লেও সরবরাহ বন্ধ থাকায় খামারের মালিকরা পোলট্রি পণ্যের দাম পাননি। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘আন্দোলন-সংঘাত আমাদের দ্বিমুখী চাপে ফেলেছে। ঝুঁকির কারণে খামারে কোনো ট্রাক আসেনি ডিম ও মুরগি নিতে। এতে যারা উৎপাদনকারী তারা ন্যায্যমূল্য পাননি। আবার সরবরাহ কমে যাওয়ায় খুচরা পর্যায়ে ডিম ও মুরগির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে দাম বেড়েছে।’
জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা : চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত কয়েক দিনের আন্দোলন-সংঘাত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আসে মূলত পাঁচটি খাত থেকে। উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ ও কৃষি। এ পাঁচটি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংঘাতের কারণে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ আন্দোলন অর্থনীতির সব সেক্টরকেই আঘাত করেছে। এটি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত না হলে এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তেমন কিছু হলে তা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেবে। জিডিপি কমে গেলে সরকারের যে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণ করা যাবে না।’