কোনো কর্মকর্তা ১৫ বছর, কেউ ১০ বছর, কেউ আট বা ছয় বছর ধরে কাজ করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করার নিয়ম না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা এ সব কর্মকর্তাকে কোনোভাবেই সরানো যায় না। কাউকে অন্য কোথাও বদলি করলেও আবার ঘুরেফিরে চলে আসে জনপ্রশাসনেই। তাই প্রশ্ন উঠেছে কী মধু আছে জনপ্রশাসনে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে ৮-১০ বছর ধরে জনপ্রশাসনে যুক্ত ছিলেন ২০ জনের বেশি কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সংস্কার হিসেবে ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে। তবে এখনো এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা, যারা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত তারা এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন জনপ্রশাসনের বিভিন্ন চেয়ার। এদের মধ্যে যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদের কর্মকর্তাই বেশি। জনপ্রশাসনে এখনো আওয়ামী লীগের সুবিধা নেওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা বহাল থাকায় অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন ওই সব কর্মকর্তাকে নিয়ে।একই পদে তিন বছরের বেশি থাকা কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করার নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। চাকরি বিধি অনুসারে তিন বছরের পর বদলির নিয়ম মানছে না খোদ জনপ্রশাসন। একই জায়গায় দীর্ঘদিন কর্মরত থাকায় কেউ কেউ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ‘মাদার মিনিস্ট্রি’ হিসেবে বদলি-পদোন্নতি, শাস্তিসহ নানা কার্যক্রম জনপ্রশাসনের হাতে থাকায় এ মন্ত্রণালয়ে কর্মরতদের একটু বেশিই সমীহ করেন অন্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরতরা। আর দীর্ঘদিন ধরে সেই সুযোগই নিচ্ছেন অনেকেই। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই কিছু বদলি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কাজ চলমান আছে। এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১০ বছরের বেশি সময়, এটা তো অস্বাভাবিক ঘটনা। এতদিন রাজনৈতিক সরকার ছিল। এখন অন্তর্বর্তী সরকার এসব কঠোরভাবে দেখবে মনে করি। এ কর্মকর্তারা কেন এক মন্ত্রণালয়ে এতদিন ধরে আছেন সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কঠোর হওয়া দরকার।
শৃঙ্খলার নামে নাঈমা হোসেনের বিশৃঙ্খলা : ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা নাঈমা হোসেন এখন যুগ্মসচিব। শৃঙ্খলা-১ অধিশাখার পাশাপাশি তদন্ত শাখার অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন তিনি। ১৩ আগস্ট ২০১৪ সাল থেকে তিনি আছেন জনপ্রশাসনে। এর মধ্যে পদোন্নতি পেয়েছেন, চেয়ার পাল্টেছে, তবে মন্ত্রণালয় ছাড়েননি। মাঝে ২০১২ ও ২০১৩ সাল বাদ দিলে ২০০৬ সাল থেকেই এ কর্মকর্তা জনপ্রশাসনে কাজ করছেন। তার স্বামীও প্রশাসনে কর্মরত। ঢাকার বাইরে দূরে থাক, সচিবালয়ের বাইরেই যেতে চান না তিনি।
নাজমা নাহারের বাহারি কান্ড : ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা উপসচিব নাজমা নাহার অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে পাত্তা দেননি, কথা বলতেন ধমকের সুরে। জুনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকেই এ কর্মকর্তার নানা কাজে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগও। প্রশাসনে এ নাজমা ইতোমধ্যেই উপাধি পেয়েছেন ‘ক্লিপ’ কর্মকর্তা হিসেবে। প্রভাবশালী কয়েক নারী কর্মকর্তার শাড়িতে ‘ক্লিপ’ ও ‘সেপটিপিন’ লাগিয়ে দিয়ে দিনের কাজ শুরু করতেন। প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের পাশে সব সময় আঠার মতো লেগে থাকতেন। এ কর্মকর্তার আরেক শক্তিশালী হাত তারই ভাই যিনি পুলিশের ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তা এসপি হুমায়ুন ডিবি প্রধান হারুনের ডান হাত হিসেবে পরিচিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডিবিতে তুলে এনেছিলেন এই নাজমারই ভাই। ভাই বোনের অদৃশ্য ক্ষমতা মিলে ২০১৮ সাল থেকে এ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ে কর্মরত। গত ছয় বছর ধরে ঢাকার বাইরে পাঠানো যায়নি এই ‘ক্লিপ’ কর্মকর্তাকে।
ভাইয়ের প্রভাবে বোনের ১৩ বছর পাড় : ২১ ব্যাচের কর্মকর্তা বর্তমানে যুগ্ম সচিব শেলিনা খানম। প্রভাবশালী ভাইয়ের প্রভাবে ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে কর্মরত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। পদোন্নতি পাওয়ার পর ডেস্ক বদল হলেও মন্ত্রণালয় বদলাতে হয়নি। এ কর্মকর্তার অন্যতম খুঁটি হলো তিনি ঢাকার সাবেক ডিসি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক শহীদুল ইসলামের বোন। ভাইয়ের প্রভাবে কেউ এ কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে পাঠাতে পারেননি। এ ছাড়াও আরেক যুগ্ম সচিব ফরিদা ইয়াসমিন যিনি এই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন ১৪ বছর ধরে। ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা ফরিদা ইয়াসমিন ২০১০ সাল থেকে জনপ্রশাসনে গেড়ে বসেছেন।
৯ বছরে মন্ত্রণালয় ছাড়েনি এনামুল : ২০১৫ সালের জুলাই থেকে জনপ্রশাসনে কর্মরত যুগ্মসচিব মো. এনামুল হক। ২২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা উপসচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্মসচিব হয়েছেন। বর্তমানে বাজেট ব্যবস্থাপনা অধিশাখার কাজ করছেন। তবে মন্ত্রণালয় ছাড়াতে পারেনি কেউ। প্রভাব দেখিয়ে ২০১৫ সাল থেকে তিনি আছেন এখানে। দেখতে দেখতে পাড় করেছেন ৯ বছর। এ ছাড়াও ২১ ব্যাচের যুগ্মসচিব মো. মেহেদী-উল-সহিদ জনপ্রশাসনে আছেন ২০১৯ সাল থেকে। যুগ্মসচিব নাসরিন সুলতানা সাত বছর ধরে জনপ্রশাসনে কাজ করছেন। বিধি-১ অধিশাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল প্রায় সাত বছর ধরে জনপ্রশাসনের মধু খাচ্ছেন। ২০ ব্যাচের এই কর্মকর্তাকে অদৃশ্য কারণে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করেনি কর্তৃপক্ষ।
উপসচিবদের ক্ষমতার দাপট : উপসচিব জাকিয়া সুলতানা নানা কৌশলে জনপ্রশাসনে মন্ত্রণালয়ে পার করে দিয়েছেন ১৪ বছর। সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা শাখা দেখেন ২৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের শুরু (২০১০ সাল) থেকেই আছেন তিনি এ মন্ত্রণালয়ে। মাঝে কিছু দিনের জন্য ছিলেন শিক্ষা প্রেষণে। সিআর-১ শাখার উপসচিব ২৪ ব্যাচের ছানিয়া আক্তার ২০১৯ সাল থেকে কাজ করছেন এ মন্ত্রণালয়ে। ২৪ ব্যাচের উপসচিব আলাউদ্দিন আলী সাত বছর ধরে আছেন এখানে। তিনি প্রশাসন-১ শাখার দায়িত্বে আছেন। ২৪ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা ড. মো. ফরিদুর রহমান ২০২১ সাল থেকে কর্মরত। এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণত তিন বছর পর বদলির কথা থাকলেও অনেক সময় অন্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়রদের অনুরোধে জনপ্রশাসন রেখে দেয়। ছয় থেকে আট বছর বা ১০ বছর ধরে যারা জনপ্রশাসনে আছেন, তাদের কেন বদলি করা যাচ্ছে না, তা কঠোরভাবে দেখা উচিত শৃঙ্খলার স্বার্থেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়ে। এটা প্রতিষ্ঠানে পেশাগত দেউলিয়াপনার সুযোগ সৃষ্টি করে। আগে অনেকক্ষেত্রে এসব ঘটছে। তবে ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনের যে চেতনা তার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ভবিষ্যতে এসব থাকবে না বলে প্রত্যাশা করি।