দেশের জনসংখ্যা নিয়ে এখন একাধিক সংখ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে বাংলাদেশে মানুষ ১৯ কোটি আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ১৭ কোটি ২৯ লাখ। এই পার্থক্য আড়াই কোটির, যা শুধু গণনার অমিল নয়, বরং রাষ্ট্রের পরিকল্পনা প্রণয়নের পুরো কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জনসংখ্যা, কর্মসংস্থান, আয়, শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই কোনো না কোনোভাবে সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই পরিসংখ্যান কতটা নির্ভরযোগ্য, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে প্রতিনিয়ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল পরিসংখ্যান মানে ভুল পরিকল্পনা। মূল সমস্যা সমন্বয়ের ঘাটতি, সৎ কর্মী এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ করে কিন্তু কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। এই সমন্বয়হীনতার পরিণতি শুধু তথ্যের বিভ্রান্তি নয়, এর প্রভাব পড়ে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও অর্থনীতিতে। মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান পরিকল্পনা, কৃষিপণ্য উৎপাদন, এমনকি আমদানি-রপ্তানির পূর্বাভাসও নির্ভর করে সঠিক পরিসংখ্যানের ওপর। বাজারে পণ্যের ঘাটতি বা বাড়তি দাম- এই ছোট ছোট সংকটের পেছনেও আছে ভুল পরিসংখ্যান। তাদের মতে, বিবিএস পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় তার স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় সংস্কারের কথা উঠেছে, টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণাও হয়েছে কিন্তু মাঠপর্যায়ে কোনো বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জাফর আহমেদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে তথ্য সংগ্রহ ভালোভাবে হয় না। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যত না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী মানুষ। এটা আমাদের মজ্জাগত সমস্যা। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি কোনো কর্মীকে দিয়ে তথ্য নিতে পাঠায় অনেক সময় তারা ঘরে বসেই ফর্ম ফিলআপ করে দেয়। এজন্য বেশি তথ্যে গরমিল থাকে। প্রতিষ্ঠানও এগুলো নজরদারি করে না। এসব দুর্বলতা কাটাতে না পারলে দেশে যতই পরিসংখ্যান হোক, বাস্তবে তার সঠিক ফলাফল আসবে না।
তিনি আরও বলেন, তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশের পদ্ধতি এখনো অনেকটা কাগজ-কলমের যুগে আটকে আছে। উন্নত দেশে যেখানে প্রতিদিন জন্ম-মৃত্যুর তথ্য সরাসরি জাতীয় ডাটাবেজে যুক্ত হয়, সেখানে বাংলাদেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এই তথ্য অনেক সময় সংরক্ষিতই থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার একটি স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন, যা সরকারের নির্বাহী প্রভাবের বাইরে থেকে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও প্রকাশ করবে। একই সঙ্গে বিবিএসকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর ও পেশাদারভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, স্থানীয় পর্যায়ে হাসপাতাল, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ- সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য সঠিক সময়ে সংযুক্ত করতে হবে।