রাজশাহী মহানগরী ২০১৬ সালে নির্মল বায়ুর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। দেশের মধ্যে পরিচিতি আছে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী হিসেবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণে রাজধানী শহর ঢাকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক বায়ু পর্যবেক্ষকদের সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজশাহী শহরের বায়ুর মান নিয়মিতভাবে ২০০-এর সীমা অতিক্রান্ত করছে। এমনকি কোনো কোনো সময় বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে তা ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। পর্যালোচনা অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৪ সালে রাজশাহী নগরীর একিউআই-এর মান ৩০০-র সীমা ছাড়িয়েছিল তিন দিন। তখন সর্বোচ্চ একিউআই-এর মান রেকর্ড করা হয়েছিল ৩১৭ এবং ২০০-এর ওপর ছিল ৪৮ দিন।
তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই নগরীর একিউআই-এর মান ৩০০ এর সীমা ছাড়িয়েছে সাত দিন। আর জানুয়ারিতে রাজশাহী শহরের একিউআই-এর মান টানা তিন দিন ৩০০-এর সীমা ছাড়িয়েছে। আর ২০০ ছাড়িয়েছে ১৮ দিন। এ সময় সর্বোচ্চ একিউআই-এর মান রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৯৪। তুলনামূলকভাবে, জানুয়ারি মাসে ঢাকায় একিউআই-এর মান ৩০০-এর ওপর রেকর্ড করা হয়েছিল মাত্র এক দিন যা সর্বোচ্চ ৩৬৭- এর সীমায় পৌঁছেছিল এবং ২৪ দিন ২০০-এর ওপর ছিল। একইভাবে ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহীতে একিউআই এর মান তিন দিন ৩০০-এর ওপর এবং ১৮ দিন ২০০-এর ওপর ছিল। যেখানে ঢাকা ৩০০-এর সীমা অতিক্রম করেছিল মাত্র একবার। গবেষকদের মতে, বায়ুদূষণের বেশ কয়েকটি নিয়ামকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হচ্ছে ফাইন পার্টিকুলার ম্যাটার বা সংক্ষেপে পিএম ২.৫। পিএম ২.৫ হচ্ছে বাতাসে মিশে থাকা অতি সূক্ষ্ম কণা যার ব্যাস মানুষের মাথার চুলের ব্যাসের প্রায় ৩০ ভাগের এক ভাগ। গাড়ি, কল-কারখানার ধোঁয়া, ইটভাটা, নির্মাণকাজ, কৃষিকাজে পোড়ানো ধুলা ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন এই কণা এতটাই ছোট যে, মানুষের ফুসফুস ও রক্ত প্রবাহের গভীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজশাহীর বাতাসে পিএম ২.৫-এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ৪৪৮.৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি।
একই সময়ে রাজশাহীর বাতাসে তুলনামূলকভাবে একটু বড় কণিকা পিএম ১০ এর সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪০৩.৪ মাইক্রোগ্রাম। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাতাসে এর ২৪ ঘণ্টার গড় পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ৪৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. আহমদ জয়নুদ্দীন বলেন, দূষণের কারণে শিশু ও বয়স্করা রোগে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। গুরুতর বায়ুদূষণের দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে ফুসফুস সম্পর্কিত রোগ- যেমন, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ যার মধ্যে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান সম্প্রতি রাজশাহী শহরের বায়ুর মান নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি শহরের বায়ুর মানের অবনতির জন্য অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কার্যক্রম, নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন ও শিল্পকারখানার নির্গমন এবং সবুজ স্থান ও জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, শুষ্ক মৌসুমে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর কার্যকলাপের কারণে শহরের তীরবর্তী পদ্মা নদীর চরের বালুকে আলগা করে তোলে। ফলে ঝোড়ো বাতাস সেই বালুকে শহরে উড়িয়ে নিয়ে এসে এ সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। তার মতে, রাজশাহী শহরের বায়ুদূষণ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ পদক্ষেপ অপরিহার্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্মাণ কার্যক্রম এবং সবুজায়ন কমে যাওয়ায় রাজশাহী শহরে বাতাসের মান খারাপ হচ্ছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, বেশকিছু উন্নয়নকাজ চলমান। ফলে ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। যার প্রভাব পড়ছে বায়ুতে। নির্মাণকাজগুলো শেষ হলে আবারও রাজশাহী আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।