কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ, এপিআই, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লাস্টিকের মতো খাতে বিপুল রপ্তানির সম্ভাবনা থাকলেও দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থা বা লজিস্টিক অবকাঠামো এবং অদক্ষ বাণিজ্য প্রক্রিয়ার কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে। ‘পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ’-এর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
লজিস্টিক বলতে বোঝায়, একটি পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিদেশি ক্রেতার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো পরিবহন, সংরক্ষণ, খালাস ও কাস্টমস প্রক্রিয়ার শৃঙ্খল। বাংলাদেশে এই শৃঙ্খলের বেশ কিছু ধাপে বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস এখনো তৈরি পোশাক খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি এসেছে পোশাক ও পোশাকজাত পণ্য থেকে। এই একক খাতনির্ভরতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একদিকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে, অন্যদিকে তৈরি করেছে নতুন ঝুঁকি। নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখন সময় এসেছে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার, তা না হলে এলডিসি উত্তরণের পর বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখা কঠিন হবে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ২ দশমিক ০৯ শতাংশ কৃষি, ২ দশমিক ৩৭ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য ১ দশমিক ৭, তৈরিকৃত পোশাক ৮১ দশমিক ৫, ০ দশমিক ৪৪ ওষুধ, প্রকৌশল যন্ত্রাংশ ১ দশমিক ১১ ও হোম টেক্সটাইল ১ দশমিক ৮১ শতাংশ রয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে আমরা কত দ্রুত আমাদের লজিস্টিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করতে পারি তার ওপর। পোশাকের বাইরে কৃষি, আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস ও লাইট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু রাস্তাঘাট, বন্দর, গুদাম ও কাস্টমস সেবা উন্নত না হলে সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নেবে না। উন্নত লজিস্টিক ছাড়া বৈচিত্র্য টেকসই হয় না। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ঘাটতিও আছে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন এক লজিস্টিক ব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে উৎপাদক থেকে ক্রেতা পর্যন্ত পণ্যের যাত্রা হবে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য।’
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের রপ্তানির প্রাণকেন্দ্র হলেও এখানেই দেখা যায় সবচেয়ে বড় সময় ও খরচের চাপ। বন্দরজট, দুর্বল অবকাঠামো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বিলম্বের কারণে রপ্তানিকারকদের ৫-৭ দিন অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হয়, যেখানে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে লাগে মাত্র ২-৩ দিন। এর ফলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে -যা বাংলাদেশকে ক্রমেই প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিচ্ছে। শুধু বন্দর নয়, সড়ক, রেল ও বিমান পরিবহনেও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ বা সাভারের মতো প্রধান শিল্পাঞ্চল থেকে বন্দরে পণ্য পরিবহনে দীর্ঘ যানজট ও দুর্বল সড়ক ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের ব্যয় বাড়ায়। অন্যদিকে কৃষিপণ্য, মাছ, ফল বা ওষুধের রপ্তানিতে শীতল সংরক্ষণ (কোল্ড চেইন) সুবিধার ঘাটতি থাকায় অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে কমে যায় বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা। পণ্য রপ্তানির অনুমতি, কাগজপত্র, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সব ধাপেই সময় ও প্রশাসনিক জটিলতা বেশি। এতে শুধু সময় নয়, রপ্তানিকারকদের খরচও বেড়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি লজিস্টিক খরচ ২৫ শতাংশ কমানো যায়, তাহলে রপ্তানি আয় অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হলে শুধু নতুন খাত চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং পুরো রপ্তানি ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সড়কজট, বন্দর বিলম্ব ও প্রশাসনিক জটিলতা যদি কাটানো না যায়, তাহলে সম্ভাবনা থাকলেও রপ্তানির গতি বারবার রুদ্ধই থাকবে।