‘গত বছর ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পরপরই আশপাশের এলাকার আন্দোলনরত ছাত্রজনতা জমায়েত হতে থাকে। ওই পরিস্থিতিতে ওসি স্যারের নির্দেশনায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ফলে রামপুরা থানা ভবনের পাশে নাদিম ও মায়া ইসলাম নামে দুজন নিহত ও মুসা খান নামে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানতে পারি।’ আন্তর্জাতিক অপরাথ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন রামপুরা থানার সাবেক এসআই মো. গোলাম কিবরিয়া খান। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে রামপুরার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন তিনি।
এদিন এ মামলায় প্রসিকিউশনের ষষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত সংস্থার সহকারী লাইব্রেরিয়ান কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিক। পরে তাদের জেরা করেন পলাতক চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন ও একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি চঞ্চল চন্দ্র
সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১০ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমানসহ মোট আসামি পাঁচজন।
অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় প্রথম নিহত হওয়া রংপুরের আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গতকালও সাক্ষ্য হাজির করতে পারেনি প্রসিকিউশন। এনিয়ে টানা তিনটি ধার্য তারিখে সাক্ষ্য হাজির না করে সময় নিয়েছে তারা। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এর আগে সাক্ষী হাজির না করার বিষয়ে খোদ ট্রাইব্যুনালও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন প্রসিকিউশনের ওপর।
রামপুরার মামলায় জবানবন্দিতে এসআই গোলাম কিবরিয়া খান জানান, বর্তমানে বাড্ডা থানায় থাকলেও গত বছর ১৯ জুলাই তিনি রামপুরা থানায় ছিলেন। এ পুলিশ কর্মকর্তা জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ১৮ জুলাই আমি থানায় অবস্থানের সময় থানার বেতার অপারেটরের মাধ্যমে জানতে পারি ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান আন্দোলন দমনে নিলিং পজিশনে গিয়ে সিআর (চাইনিজ রাইফেল) ফায়ার করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজের পর দুপুর ২টায় রামপুরাস্থ বিটিভি ভবনের ৩ নম্বর গেটে আমার ডিউটি নির্ধারিত থাকলেও ওসি স্যার আমিসহ আমাদের সব পুলিশ সদস্যকে থানায় অবস্থান করার নির্দেশ দেন। ওই দিন জুমার নামাজের পরপরই থানার আশপাশের এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্রজনতা জমায়েত হতে থাকে। ওই পরিস্থিতিতে থানার বেতার অপারেটর আবদুর রহমান অফিসার ইনচার্জ স্যারকে বেতার বার্তার মাধ্যমে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন।’
জবানবন্দিতে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই বার্তা পেয়ে অফিসার ইনচার্জ মশিউর রহমান স্যার, খিলগাঁও জোনের তৎকালীন এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম স্যার বিজিবির এপিসি নিয়ে সোয়া ২টা থেকে আড়াইটার দিকে রামপুরা থানায় আসেন।
ওই পরিস্থিতিতে স্যারদের নির্দেশনায় আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ফলে রামপুরা থানা ভবনের পাশে বনশ্রী জামে মসজিদের পাশে নাদিম নামে একজন ব্যক্তি নিহত হয়। থানার পাশর্^বর্তী রাস্তায় মায়া ইসলাম নামে একজন নিহত ও মুসা খান নামে একজন শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় বলে জানতে পেরেছি।’
আবু সাঈদের মামলায় সাক্ষী আনতে পারেনি প্রসিকিউশন : জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষী না আসায় আবারও পিছিয়েছে সাক্ষ্য গ্রহণ। পরে প্রসিকিউশনের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১০ নভেম্বর এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েল সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ আসামির বিরুদ্ধে করা এ মামলায় টানা তিনটি ধার্য তারিখে সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রসিকিউশন। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর ও ২০ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু সাংবাদিকদের বলেন, আইনের একটি ভিত্তি হলো প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিস। সেই প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিস ও ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার-২০০৯ অনুযায়ী আদালতে যেসব আবেদন কোনো একপক্ষ দেবে, অপরপক্ষকে এর অনুলিপি হস্তান্তর করতে হয়। গত তিনটি ধার্য তারিখে সাক্ষী উপস্থাপনের জন্য সময়ের আবেদন দিয়েছেন প্রসিকিউশন। কিন্তু আইন অনুযায়ী আমরা কোনো কাগজ পাইনি। এরপরও দেখলাম সাক্ষী উপস্থিত হয়নি।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের দায়িত্ব হলো কোনো ব্যক্তি বা আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) প্রমাণ করা। এর অন্যতম প্রক্রিয়া সাক্ষী উপস্থাপন করা। অথচ সেই সাক্ষীই গত তিন কার্যদিবসে হাজির হয়নি। আমরা কারণ জানতে না পারলেও প্রতীয়মান হয় যে, প্রসিকিউশনের ব্যর্থতার কারণে আদালতে আসেননি সাক্ষী।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেস্টমেন্ট) উপস্থাপন করা হয়। সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর এ সময়ের মধ্যে মাত্র ছয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।