জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) পুলিশের সাবেক এসআই শেখ আবজালুল হককে জেরা করার সময় প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ এ ঘটনা ঘটে। পরে এ মামলার জেরা শেষে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২৬ নভেম্বর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে রাজসাক্ষী আবজালুল গত বুধবার জবানবন্দি দেন। তিনি গণ অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার আশুলিয়া থানায় কর্মরত ছিলেন। জবানবন্দি শেষে গতকাল তাকে জেরা শুরু করেন এ মামলার আসামি আবদুল্লাহিল কাফীর আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান। বুধবার আংশিক জেরা করেন তিনি। পরে গতকাল সকালে আবার জেরা শুরু করেন আইনজীবী মিজানুর রহমান। জেরার জবাবে রাজসাক্ষী আবজালুল বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট তিনি (আবজালুল) অনুমতি ছাড়া আশুলিয়া থানা ত্যাগ করেন। তারপর গত বছরের ১৫ আগস্ট তিনি থানায় আসেন।
তারপর আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান প্রশ্ন করেন, থানায় এসে এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) রাজু মারা যাওয়ার কথা শুনেছিলেন কিনা? মূলত এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই প্রসিকিউটর ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমানের এই প্রশ্নের বিরোধিতা করেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজসাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে, তবে তাকে এ ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেন, একজন দারোগাকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, এই প্রশ্ন করা যাবে না। এ রকম বিচার করতে কোর্ট এখানে বসেন নাই। প্রসিকিউশন যেমন একজন মায়ের আবেদনে বিচারে এখানে এসেছে, তেমনি এটাও আরেক স্ত্রীর (নিহত পুলিশের স্ত্রী) আবেদন বলে উল্লেখ করেন আইনজীবী মিজানুর রহমান। তখন তাঁর হাতে ছিল এএসআই রাজুর স্ত্রীর করা মামলার কাগজ।
এ পর্যায়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর যে ডকুমেন্টস এনেছেন, এটা দেখানোর অনুমতি আছে কিনা? ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর (আসামিপক্ষের সাক্ষী) তালিকা ও ডকুমেন্টস দিতে হবে তাদের। তারা সেটা দিয়েছেন? এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেন, আরেকটা সুখরঞ্জন বালি (দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে গুম হন সুখরঞ্জন বালি) তৈরি করতে চান? সাফাই সাক্ষীর নাম দিলে শুরু হয়ে যায় থ্রেট (হুমকি দেওয়া) করা।
এর জবাবে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, তাদের (আসামিপক্ষের আইনজীবীদের) কোর্টে আসাই উচিত হয়নি। তারা বলতে পারেন, এটা হাইড (সাফাই সাক্ষীর পরিচয় গোপন রাখা) রাখুন। তারা এটা বলেছেন? উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের এ পর্যায়ে দুই পক্ষকেই (প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবী) দোষারোপ করেন ট্রাইব্যুনাল। এ সময় ট্রাইব্যুনাল ‘সাক্ষ্য নিতে গেলেই এত কাহিনি’ বলে মন্তব্য করেন।
এ সময় প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, যদি বলা হয় এটা খারাপ আইন; এই কোর্টে দাঁড়িয়ে কেউ বলতে পারবে না এই আইন মানি না। কোর্টের বাইরে গিয়ে বলতে হবে। এরপর ট্রাইব্যুনাল বলেন, আইনকে আইনের মতো করে প্রয়োগ করলে কাজ হয়। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেন, আইনে বলা আছে অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) তার জ্ঞানে থাকা ঘটনা সম্পর্কে সত্য ও পূর্ণ প্রকাশ করবেন। এটা তার জ্ঞানের (নলেজ) মধ্যেই আছে। এর জবাবে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি এই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।
এ পর্যায়ে রাজসাক্ষী আবজালুলকে সাবেক এএসআই রাজুর স্ত্রীর করা মামলা প্রসঙ্গে আবার প্রশ্ন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আবার আপত্তি জানিয়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, আবজালুলের বিশ্বাসযোগ্যতা (ক্রেডিবিলিটি) সম্পর্কে প্রশ্ন করা যাবে, এ বিষয়ে নয়। এ সময় তাহলে এটা কীসের বিষয়, এই প্রশ্ন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান। উত্তেজিত হয়ে প্রসিকিউশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইন কমপ্লাই (আইনের ভিত্তিতে কথা বলা) করছেন, কিন্তু গায়ের জোরের কাছে পারছেন না। এরপর প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলামও উত্তেজিত হয়ে যান। তিনি উচ্চস্বরে বারবার বলতে থাকেন ‘হোয়াট ইজ দিস’। তখন ট্রাইব্যুনাল কোর্টের পরিবেশ বজায় রাখার অনুরোধ করেন।
একপর্যায়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম দুটি কথা বলার অনুমতি চান ট্রাইব্যুনালের কাছে। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, একটু আস্তে কথা বলবেন। প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর শুরু থেকেই প্রত্যেক সাক্ষীকে এ বিষয়ে (আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যা) জেরা করছেন। তাকে ট্রাইব্যুনালে এসব ডকুমেন্টস দিতে কে বাধা দিয়েছে? এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান এর জবাব দিতে গেলে ট্রাইব্যুনাল পরের প্রশ্নে যাওয়ার অনুরোধ করেন। মিজানুর রহমানও রাজসাক্ষীকে পরে অন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন।