বিশ্বে ধনকুবেরের সংখ্যা কম নয়। তবে রাজকীয় ঐশ্বর্য আর বিলাসিতায় অনেককেই ছাড়িয়ে গেছেন থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণ, যিনি রাম দশম নামেও পরিচিত। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭২ বছর বয়সি এই রাজা বর্তমানে বিশ্বের ‘সবচেয়ে ধনী’ রাজা।
মহা ভাজিরালংকর্ণের বাবা রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ। তিনি ৭০ বছর ধরে থাইল্যান্ডে শাসন করেছিলেন। বিশ্বের দীর্ঘ দিন শাসন করা রাজাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর ৮৮ বছর বয়সে ভূমিবলের মৃত্যু হয়। তারপর ২০১৯ সালের মে মাসে বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ মতে রাজ্যাভিষেক হয় মহা ভাজিরালংকর্ণের।
থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণ বিপুল সম্পত্তির মালিক। তবে বিলাসবহুল এবং রঙিন জীবনযাপনের জন্যই খবরের শিরোনামে বেশি উঠে এসেছেন তিনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভাজিরালংকর্ণের মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৩.৭ লাখ কোটি টাকা।
এই বিশাল সম্পদের বেশির ভাগই রাজা পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তবে বিভিন্ন নামীদামি সংস্থা এবং জমিতে বিনিয়োগ করে সম্পত্তির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তোলেন তিনি। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, থাইল্যান্ড জুড়ে হাজার হাজার একর জমি রয়েছে মহা বাজিরালংকর্ণের। কেবল ব্যাঙ্ককেই ১৭ হাজারের বেশি স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
মহা ভাজিরালংকর্ণের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা কল্পনাতীত। ৩০০টিরও বেশি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তার, যার মধ্যে মার্সিডিজ় বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, লিমুজিন অন্যতম। ৩৮টি ব্যক্তিগত বিমানও রয়েছে তাইল্যান্ড-রাজের। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির অন্দরসজ্জা করা হয়েছে সোনা দিয়ে। তবে মহা ভাজিরালংকর্ণের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসপত্রের মধ্যে অন্যতম হল ৫২টি নৌকা। এগুলি কোনো সাধারণ নৌকা নয়। সম্পূর্ণ সোনা দিয়ে সজ্জিত নৌকাগুলি শুধুমাত্র রাজকীয় অনুষ্ঠানের সময় ব্যবহৃত হয়।
এত সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও মহা ভাজিরালংকর্ণের সম্পত্তির পরিমাণ কিন্তু মুকেশ অম্বানী বা গৌতম আদানির মতো ভারতীয় শিল্পপতির চেয়ে কম। ২০২৫ সালের মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, অম্বানী এবং আদানি ভারতের প্রথম দুই ধনী ব্যবসায়ী। রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান মুকেশ অম্বানী ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭.৯ লাখ কোটি টাকা।
অন্য দিকে, ভারতের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় গৌতম আদানির স্থান দ্বিতীয়। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪.৮১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দুইজনের সম্পত্তির পরিমাণই ভাজিরালংকর্ণের থেকে অনেকটাই বেশি। মহা ভাজিরালংকর্ণের জন্ম ১৯৫২ সালে। প্রয়াত রাজা ভূমিবল এবং রানি সিরিকিতের চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র পুত্র তিনি।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাজিরালংকর্ণের প্রাথমিক শিক্ষা থাইল্যান্ডে। পরে ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। পরে ক্যানবেরার ডানট্রুনের রয়্যাল মিলিটারি কলেজে ভর্তি হন।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামরিক শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন মহা ভাজিরালংকর্ণ। তিনি একজন প্রশিক্ষিত সেনা। ফাইটার জেট এবং হেলিকপ্টার ওড়ানোয় দক্ষতা রয়েছে তার। তাই সেনাবাহিনীর সেনাকর্তা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
১৯৭০-এর দশকে তাইল্যান্ডের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী দমনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন মহা ভাজিরালংকর্ণ। থাইল্যান্ডের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী সন্ন্যাসজীবনও পালন করেছেন মহা ভাজিরালংকর্ণ। ১৯৭৮ সালে তিনি দু’সপ্তাহের জন্য এক বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসাবে ছিলেন। তার আগে ১৯৭৭ সালে ভাজিরালংকর্ণ বিয়ে করেন তার আত্মীয়া সোওয়ামসায়ালি কিতিয়াকারাকে। সে বছরেই জন্ম হয় তাদের একমাত্র কন্যা বজ্রকিতিয়াভার।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যুবরাজ ভাজিরালংকর্ণ লিভ ইন শুরু করেন অভিনেত্রী যুবধিদা পলপ্রাসার্থের সঙ্গে। জন্ম হয় তাদের পাঁচ সন্তানের— চার ছেলে এবং এক মেয়ে। কিন্তু দীর্ঘ দিন তাঁকে ডিভোর্স দেননি স্ত্রী কিতিয়াকারা। তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয় ১৯৯৩ সালে। ব্যর্থ বিয়ের দায় পুরোটাই স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেন সেকালের যুবরাজ, আজকের রাজা। ১৯৯৪ সালে যুবধিদা পলপ্রাসার্থকে বিয়ে করেন ভাজিরালংকর্ণ। বিয়ের পরে যুবরানির নতুন নাম হয় সুজারিনী ভিভাচারাওয়ংসে। কিন্তু বিয়ের দু’বছর পরে সন্তানদের নিয়ে সুজারিনী প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যান আমেরিকায়। পরে ভাজিরালংকর্ণ তার কন্যাকে তাইল্যান্ডে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু চার ছেলে থেকে যান তাদের মায়ের সঙ্গেই।
ওই চার সন্তানের সব কূটনৈতিক সুবিধা এবং রাজপরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়। যে মেয়েকে নিজের কাছে আনতে পেরেছিলেন, তাকে থাইল্যান্ডের রাজকন্যার পরিচয় দেওয়া হয়। ২০০১ সালে তৃতীয় বিয়ে করেন ভাজিরালংকর্ণ। স্ত্রী শ্রীরশ্মি সুওয়াদি ছিলেন সাধারণ নাগরিক। কোনও রাজপরিচয় তার ছিল না। চার বছর পরে পুত্রসন্তানের জন্মের পরে তাদের বিয়ের কথা প্রকাশ্যে আনা হয়।
বিয়ের ১৩ বছর পরে ভেঙে যায় ভাজিরালংকর্ণের তৃতীয় দাম্পত্য। বাজিরালংকর্ণের অভিযোগ ছিল, সুওয়াদির পরিবারের সদস্যেরা দুর্নীতিতে জড়িত। ফলে তাদের কাছ থেকেও কেড়ে নেওয়া হয় প্রাপ্য রাজোচিত সুযোগ-সুবিধা। ২০১৯-এ রাজ্যাভিষেকের তিন দিন আগে চতুর্থ বিয়ে করেন ভাজিরালংকর্ণ। সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি পাণিগ্রহণ করেন ব্যক্তিগত রক্ষী দলের উপপ্রধান সুথিদাকে। বিয়ের পরই সুথিদাকে ‘রানি’ উপাধি দেন রাজা।
সুথিদা তিদজাই আগে ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্ট ছিলেন। ২০১৪ সালে রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণ তাকে ব্যক্তিগত রক্ষী দলের ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত করেন। কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যম বিয়ের আগেই সুথিদা ও রাজার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের খবর ফাঁস করে। তবে রাজপ্রাসাদের তরফে বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।
করোনা অতিমারির সময় বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছিল মহা ভাজিরালংকর্ণকে। করোনা পরিস্থিতির জেরে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে থাইল্যান্ড জুড়ে জারি হয় জরুরি অবস্থা। তার মধ্যে দেশবাসীকে রেখে রাজা চলে যান নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। থাইল্যান্ডের রাজার নিভৃতবাস তার জীবনযাত্রার থেকেও রাজকীয় ছিল। জার্মানির বাভারিয়ান আল্পসের বিখ্যাত হোটেল ‘গ্র্যান্ড হোটেল সোনেনবিখল’-এ আশ্রয় নেন তিনি। হোটেলে সাধারণ পর্যটকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রাজার জন্য সেই নিয়ম শিথিল করে খুলে দেওয়া হয়েছিল দরজা।
নিভৃতবাসে নাকি রাজার সঙ্গী ছিলেন ২০ জন তরুণী। এই হোটেলের একটি বড় অংশে বেশ কিছু পরিবর্তনও করা হয়েছিল রাজার ইচ্ছানুসারে। কিন্তু এর জন্য তীব্র সমালোচিত হন থাইল্যান্ডের রাজা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও তার এই সিদ্ধান্তকে ‘পলাতক’ মনোভাব বলে তকমা দিয়েছিল।
সূত্র: আনন্দবাজার
বিডি প্রতিদিন/নাজিম