হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর, বাংলাদেশে মোট ৪০টির মতো জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। জঙ্গিবাদের কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২২ হাজার ৭শ’ জনের মৃত্যু হয়েছে, হিন্দুদের ৩০০টি মন্দির ৫০০টি বাড়ি এবং ২০০ দোকান ভাংচুর করেছে তারা। রাজনৈতিক ভেদাভেদের কারণে জঙ্গিবাদ আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। জামায়াতই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের জনক। অথচ, রাজনৈতিক কারণে সরকার সব জেনেও সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না।
শনিবার রাজধানীর রেডিসন হোটেলের লহরী হলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদের হুমকি: বাংলাদেশের ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সেমিনারটি চলে।
সেমিনারে বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, সরকারে থাকা ১৪ দলের নেতারা যদি মন্ত্রীত্ব আর সুবিধার রাজনীতি করেন তাহলে আমরা জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি পাবো না। নেতাদের জনগণের কাছে যাওয়া উচিত। তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন, যার প্রমাণ প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচন। যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, যেভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছে তারপরও তারা কীভাবে এতো জনসমর্থন পায়? সরকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ড. মিজান বলেন, মানবাধিকার আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এটা আজ হুমকি নয়, বাস্তবতা। জঙ্গিবাদ নির্মূল করা দরকার। তবে বিচার বহির্ভুত হত্যা, গুমের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব নয়। আইনের মাধ্যমে, সন্ত্রাস বিরোধী আইনকে কার্যকর করে এটা করা সম্ভব।
ইসলামী ঐক্যজোটের সভাপতি মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ গঠনের জনক। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছে। ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করে জঙ্গিবাদের অর্থ সংগ্রহ করে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করছে। বাংলাদেশের ছাত্ররা নৈতিক ও সত্যিকারের ধর্মীয় শিক্ষা পাচ্ছে না বলে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রাষ্ট্রের পৃষ্টপোশকতায় বিভিন্ন সময়ে জিহাদ ও পর্দার অপব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ মুক্ত করতে ইমাম ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বার বার বলা হয় জামায়াত জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, যদি তাই হয় তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না কেন? জঙ্গি সংগঠন হিসেবে হিজবুত তাহরীর ও জেএমবিকে তো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদকে আংশিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কখনো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। জঙ্গিবাদ দমনে আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গিবাদের অবস্থান ও তাদের সাথে বাংলাদেশের কোন কোন সংগঠনের সম্পর্ক রয়েছে তা বের করতে হবে।
রাজনৈতিক বিভাজন থাকলে জঙ্গিবাদের সমস্যার সুরাহা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.)সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ কোন দলের সমস্যা নয়, এটি এখন দেশের জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক বিভাজন বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্ররা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এটি একটি ভুল ধারণা। কেননা দেশের মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় পড়ে। শুধু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা নয়, উচ্চশিক্ষিত লোকজনও এই জঙ্গিবাদে সক্রিয় রয়েছে।
সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ধর্মের রাজনীতি ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আধুনিক বিশ্বের জন্য সবচে বেশি হুমকি। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতার সঙ্গে ধর্ম মিলিয়ে ফেলার কারণে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। বর্তমানে বিশ্বের দানবে পরিণত হয়েছে এই ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় গ্লোবাল টাস্কফোর্স গঠন এবং সরকারের প্রগতিশীল দল এবং সংগঠনগুলোকে ভূমিকা রাখার কথাও বলেন তিনি।
জঙ্গি দমনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করার আহ্বান জানান সমকাল পত্রিকার সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নে জঙ্গিবাদ বড় বাধা, এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াসহ প্রয়োজনে জঙ্গিবাদের মামলার নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তৈরির আহ্বান জানাই। অন্যান্য বক্তাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বার বার জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতের নাম আসলেও সরকার কি রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের নিষিদ্ধ করছে না?
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের বলেন, জঙ্গিবাদের শুরু ১৯৭১ সাল থেকে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করলেও জঙ্গিবাদ আমাদের ছেড়ে যায়নি। একাত্তরের অপশক্তিটি এখনো বাংলাদেশ ছাড়েনি বলে জঙ্গিবাদও আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। ফলে দেশের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কে জঙ্গিবাদের অবস্থান রয়েছে। জঙ্গিবাদের একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেই নেটওয়ার্ক যদি আমরা না বুঝি তবে জঙ্গিবাদ দমন অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে আমেরিকার অবস্থান রয়েছে। তুরস্ক থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সব দেশের পতন হয়েছে জঙ্গিবাদের জন্য। এদেশে ব্রিটিশ সরকারের মদদে জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হস্তক্ষেপের জন্য জঙ্গিবাদের পৃষ্টপোষকতা করছে উন্নত দেশগুলো। এদেশে জামায়াত থাকলে জঙ্গিবাদ থাকবেই।
অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রশিদ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জামাতুল মুজাহিদিনসহ বাংলাদেশে ৪০টির মতো জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। জঙ্গিবাদের কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২২ হাজার ৭শ’ জনের মৃত্যু হয়েছে, হিন্দুদের ৩০০টি মন্দির, ৫০০টি বাড়ি এবং ২০০ দোকান ভাংচুর হয়েছে। জঙ্গিবাদ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তথাকথিত জিহাদ ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মের নামে ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মতো ইসলামী দেশগুলোতে জঙ্গিবাদ চলছে। জঙ্গিবাদি সংগঠনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের খুব দ্রুত অবস্থান নেওয়া উচিৎ।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমির, নারী নেত্রী খুশী কবির, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, সুজনের নির্বাহী পরিচালক বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ।
এছাড়া সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নূরন্নবীসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্টজন ভিডিও’র মাধ্যমে সেমিনারে সংযুক্ত হন।