লক্ষ্মীপুরে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েই চলেছে খুন ও অপহরণের ঘটনা। প্রতিনিয়ত ডোবা-নালায়, খালে-বিলে লাশ মিললেও গুম ও অপহৃতদের অনেকেরই সন্ধান মিলছে না। কখনো র্যাব, ডিবি পরিচয়ে আবার কখনো চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাতে গুম ও অপহরণ হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এসব ঘটনায় জড়িত খুনি ও অপহরণকারীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হত্যার রহস্যও বের করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুধু 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হওয়ার ঘটনা পুলিশ অথবা র্যাবের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বছর ১৭টি হত্যাকাণ্ড, নারী-শিশুসহ ২৮ জন অপহরণ, বিএনপি নেতাসহ দুজন গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে জেলায়। সর্বশেষ ১৩ এপ্রিল দত্তপাড়া ইউনিয়নের বড়ালিয়ায় প্রবাসী কামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা, ৩ এপ্রিল হামছাদী ইউনিয়নের যুবলীগ কর্মী রবিউল ইসলাম, ৩১ মার্চ দুর্গাপুর গ্রামে ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি কবির হোসেন, ২০ মার্চ রামগঞ্জের করপাড়া ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নুর হোসেন, ৬ ফেব্রুয়ারি সদরের নলডগী গ্রামের ইউপি সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামে যুবলীগ কর্মীকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। ২২ জানুয়ারি র্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন যুবদল কর্মী, পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী দিদার হোসেন। ৭ ফেব্রুয়ারি শেখপুর গ্রামের যুবদল কর্মী আবুল হোসেন, ১২ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর গ্রামের যুবদল কর্মী শাহাদাত হোসেন, ১৭ মার্চ সোনাপুর গ্রামের যুবদল কর্মী বাবর হোসেন, ১৯ মার্চ কাজিরচর গ্রামের বিএনপি কর্মী শাকিল হোসেন সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এ ছাড়া আরও ছয়টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। এসবের বেশির ভাগই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে মনে করছেন নেতারা। এদিকে চাঁদা দাবি, পারিবারিক বিরোধ ও প্রেমসংক্রান্ত বিষয়ে ২৮ জন অপহরণ ও রাজনৈতিক কারণে দুজন গুম হন বলে জানা যায়। জানুয়ারিতে ৬, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১০ ও ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত তিন_ এ ২৮ জন অপহৃত ও দুজন গুম হন। সর্বশেষ ১০ মার্চ চাঁদার দাবিতে সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের করইতোলা গ্রাম থেকে জাফর ও বাচ্চু নামের দুই সহোদরকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। জাফরকে ছেড়ে দেওয়া হলেও এখনো বাচ্চুর কোনো সন্ধান পায়নি তার পরিবার। এ ব্যাপারে সদর থানায় মামলা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান দত্তপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ওয়াহিদুজ্জামান বিশ্বাস। ৯ মার্চ ৫ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে সদর উপজেলার বশিকপুর গ্রামে কাজী মাহমুদুল হক নান্নুর অফিস সহকারী আবদুর রহিমকে পিস্তল ঠেকিয়ে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এখনো সন্ধান মেলেনি তার। ১৫ মার্চ উপজেলার দেওপাড়া গ্রাম থেকে জিনিয়া হোসনা আফরোজ ও তার তিন বছরের কন্যা সানজিদাকে মাইক্রোবাসযোগে ১৫-২০ জনের মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। সদর থানায় অপহৃতার মা আয়শা আক্তার পারুল বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। তবে এখন পর্যন্ত অপহৃতদের উদ্ধার ও জড়িতদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি বলে জানান পারুল আক্তার। নন্দনপুর গ্রামে ৪ মার্চ প্রবাসী পরিবারের কাছে চাঁদা না পাওয়ায় মোবারক হোসেন নামে এক ব্যক্তি অপহৃত হন বলে জানা যায়। ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আত্দীয়ের বাসা থেকে সদর উপজেলার হাজিরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুককে র্যাব পরিচয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ পরিবারের। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি। উপজেলা নির্বাচনের আগে ২৯ মার্চ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাহমুদুল করিম দিপুর বাসায় র্যাব পরিচয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার সময় তার সমর্থক, মান্দারী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রুবেল হোসেন নিখোঁজ হন। এর পর থেকে তার সন্ধান মিলছে না বলে জানান এলাকাবাসী। জেলা বিএনপির সভাপতি, কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের ভূঁইয়া জানান, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামসহ ৩৯ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল মেয়াদে ও বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন মাসে লক্ষ্মীপুরে বিএনপির ২৩ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা ও অপহরণ করা হয়েছে। সরকারি দলের লোকজন এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে দাবি করেন তিনি। বিভিন্ন মামলায় বিএনপির প্রায় ২৮ হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম আলাউদ্দিন জানান, লক্ষ্মীপুরে আবারও সন্ত্রাসী বাহিনী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলে অনেক অস্ত্রধারী বাহিনী গড়ে উঠেছে, যারা প্রতিনিয়ত খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের ১৮ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হলে এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে না। লক্ষ্মীপুরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার শেখ শরীফুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। তিনি জানান, অপহরণের বেশির ভাগই প্রেমসংক্রান্ত, আর কিছু ঘটনা চাঁদার দাবিতে হচ্ছে। তবে কিছু অপহৃতকে উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদের উদ্ধারে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।