স্মরণকালের ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার নিহত ১০৩ পোশাকশ্রমিকের পরিচয় দুই বছরেও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখনো এসব শ্রমিকের স্বজনরা তাদের পরিচয় শনাক্ত করার দাবি করে আসছেন। কিন্তু বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা এই ১০৩ কবরের ডিএনএ নমুনার কোড (নম্বর ফলক) ঝড়-বৃষ্টির কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জুরাইন কবরস্থানে কবরগুলোয় এখন শনাক্তকরণের কোনো নম্বরই নেই।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আজকের দিনে রানা প্লাজা ধসে সরকারের হিসাবে ১ হাজার ১৩৪ জন নিহত হন। এর মধ্যে ৮১২টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৩২২টি লাশের নমুনা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। বেওয়ারিশ লাশগুলো আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয় রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেওয়া নমুনার সঙ্গে মিল রেখে কবরস্থানে প্রতিটি কবরে একটি শনাক্তকরণ নম্বর দেওয়া হয়। শক্ত কাগজে লেখা শনাক্তকরণ নম্বর প্লেট মুছে গেছে।
কবরস্থান সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী নম্বর প্লেট না দেওয়ায় ঝড়-বৃষ্টির কারণে এগুলো মুছে গেছে। এনএফডিপিএল সূত্র জানায়, নিহতদের মধ্যে পরিচয়হীন ৩২২ লাশের ৩২২টি নমুনা হিসেবে হাড় ও দাঁত দেওয়া হয় ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। আর অজ্ঞাত এসব লাশের মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে হিসেবে স্বজন দাবিদার ৫৬০ জন তাদের রক্ত নমুনা দেন ল্যাবরেটরিতে। লাশের ডিএনএ রূপরেখা (প্রোফাইল) তৈরি শেষে এ পর্যন্ত ২০৮ লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়। তবে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৩২২টি লাশ হিসেবে নমুনা দেওয়া হলেও এর মধ্যে ১১ জনের নমুনা দুবার করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১১ জনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ২২ জনের লাশ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা পড়ে। এ হিসেবে লাশের প্রকৃত সংখ্যা হবে ৩১১। এ হিসেবে এখনো ১০৩ লাশের পরিচয় জানা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে স্বজন দাবি করে চারজন রক্তের নমুনা দেন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। এতে দুটি লাশের ডিএনএর সঙ্গে দুই স্বজনের ডিএনএর মিল (ম্যাচিং) পাওয়া যায়। পরে ২১ জানুয়ারি তথ্য হালনাগাদ করে এনএফডিপিএল থেকে একটি প্রতিবেদন শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রথম দফায় ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর ১৫৭ লাশ শনাক্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল সরকারকে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার এফবিআইর (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) বিনামূল্যে দেওয়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্বাইন্ড আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (কোডিস) সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিএনএ রূপরেখা মেলানোর কাজ দ্রুত ও সহজ হয়।
ডিএনএ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুর্ঘটনার পর যেসব লাশ স্বজনরা শনাক্ত করেছেন কিংবা হস্তান্তর করা হয়েছে তা হয়তো নির্ভুলভাবে হয়নি। অনেক লাশ বিকৃত হওয়ায় জামা-কাপড় দেখে শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। সে সময় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও লাশ দাবিদার স্বজনদের সঠিকভাবে যাচাই করতে পারেনি, হয়তো সম্ভবও ছিল না। দ্রুততার সঙ্গে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এ কারণে পরীক্ষায় যেসব স্বজনের ডিএনএ রূপরেখায় মিল পাওয়া যায়নি তাদের দাবিকৃত লাশ হয়তো অন্যত্র হস্তান্তরিত হয়েছে।
এদিকে, রানা প্লাজা ধ্বংসস্তূপ থেকে কয়েক দফায় উদ্ধার হওয়া ৭০টির বেশি হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় বলে স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে এনএফডিপিএল থেকে এ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে সরকারের কাছে জমা দেওয়া লাশ শনাক্তকরণ প্রতিবেদনে বাকি অশনাক্ত লাশের করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে বলা হয়- ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া যেসব লাশ হস্তান্তর হয়েছে তা ডিএনএ পরীক্ষার আওতায় আনা যেতে পারে। এজন্য ওইসব লাশ (৮১২) এবং তাদের দাবিদার স্বজনদের নমুনা প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুলও।
এনএফডিপিএলের জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান জানান, ১০৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। অশনাক্তদের শনাক্ত করার ব্যাপারে সরকারের কাছে একটি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এটি অনেক সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। সরকার যদি সিদ্ধান্ত দেয় তবেই সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।
বিডি-প্রতিদিন/২৪ এপ্রিল, ২০১৫/মাহবুব