আত্মসমর্পণ করেছে সুন্দরবনের গহিন অরণ্যে দাপিয়ে বেড়ানো দুর্ধর্ষ মজনু ও ইলিয়াছ বাহিনীর প্রধানসহ ১১ বনদস্যু। আজ দুপুরে বাগেরহাটের মংলায় বিএফডিসি (ফুয়েল) জেটিতে ২৫টি বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১ হাজার ২০ রাউন্ড গোলাবারুদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে তুলে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বনদস্যু আত্মসমর্পণ করেন।
আত্মসমর্পণকারী বনদস্যুরা হলেন, খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর সবুজ সংঘ মাঠ এলাকার আমীর আলী গাজীর ছেলে মজনু বাহিনীর প্রধান মোঃ মজনু গাজী (৪৩), তালিনচি এলাকার আবু দাউদ গাজীর ছেলে রবিউল ইসলাম (২৮), সাতক্ষীরা মুন্সিগঞ্জ এলাকার মোহাম্মদ আলী গাজীর ছেলে ইসমাইল গাজী (৫০), সাতক্ষীরা শ্যামনগরের সালাম সরদারের ছেলে এনামুল সরদার (২৭), কাঠমারচর এলাকার আনসার আলীর ছেলে ইদ্রিস আলী (২৮), মঠবাড়ি এলাকার মৃত আব্দুল মোল্লার ছেলে আবুল কালাম আজাদ (২০), কয়রা বেদকাশি এলাকার তছির শেখের ছেলে মনজু শেখ (৪৩), পাইকগাছা বিরাশি এলাকার মৃত আজিজ মোড়লের ছেলে জাহাঙ্গীর মোড়ল (২২), শ্যামনগর দাতিনাখালী মৃত লোকমান গাজীর ছেলে বাবুল হাসান (২৪) এবং ইলিয়াছ বাহিনীর প্রধান খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর এলাকার আবু বক্কার গাজীর ছেলে মোঃ ইলিয়াছ গাজী (২৭) ও কয়রার তেতুলতলা গ্রামের আব্দুস সবুর গাজীর ছেলে নাছির উদ্দিন (৩৩)।
দুই বাহিনীর সমর্পণ করা আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১১টি বিদেশি একনলা বন্দুক, ৩টি বিদেশি দোনলা বন্দুক, ২২ বোর বিদেশি এয়ার রাইফেল ২টি, ওয়ান শুটার গান ৩টি, সাটারগান ৫টি, রিভালবার ১টি ও ১ হাজার ২০ রাইন্ড বিভিন্ন প্রকার গোলাবারুদ।
এর আগে গত ৩১ মে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদল মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টারসহ ১০ সদস্য বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবানের ধারবাহিকতায় এসব বনদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানা গেছে।
শুক্রবার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবারো সুন্দরবনের অন্যান্য বনদস্যু বাহিনীগুলোকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইলে তারাও এই সুযোগ পাবেন। তবে দস্যুতা চালিয়ে যেতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনে দস্যুতা সহ্য করা হবে না। র্যাব ও কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আমরা কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই না। তবে দস্যুতা না ছাড়লে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা দস্যুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, যারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে, তাদের স্বাগত জানাই। তাদের আইনগত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, পুলিশের খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি মোঃ মনিরুজ্জামান, র্যাব-৮ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফরিদুল আলম, র্যাব-৬ এর অধিনায়ক খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মোঃ হারুন-অর রশীদ বিশ্বাস, পুলিশ সুপার মো. নিজামুল হক মোল্যা, ডিএফও (পূর্ব) সাইদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, শুক্রবার রাত ১টায় আত্মসমর্পণের সুযোগ নিতে মজনু বাহিনীর ৯ সদস্য খুলনার দাকোপ থানার টাপামারি খালের দক্ষিণ পাড়ে এসে তাদের ব্যবহৃত দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ র্যাব-৮ এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। শুক্রবার সকালে খুলনার দাকোপ থানার পশুর নদী সংলগ্ন কালীর খালে ইলিয়াছ বাহিনীর আরও দুই সদস্য তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে আত্মসমর্পণ করে। তবে র্যাবের অপর একটি সূত্র জানায়, গত বুধবার আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ৭ জন আত্মসমর্পণ করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মংলায় ওইদিন আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ স্থগিত করে র্যাব। পরে তাদেরকে দিয়ে গভীন বনে বাহিনীর অন্য সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা হলে আরও ৪ সদস্য আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়।
র্যাব সূত্র জানায়, সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ (খুলনা ও সাতক্ষীরা) ও বঙ্গোপসাগরে ত্রাস সৃষ্টিকারী বনদস্যু মজনু ও ইলিয়াছ বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজছে, এমন খবরের ভিত্তিতে র্যাবের গোয়েন্দা দল তৎপরতা শুরু করে। এক পর্যায়ে মজনু ও ইলিয়াছ বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে র্যাবের কাছে নিশ্চয়তা চায়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে মজনু ও ইলিয়াছ বাহিনীর প্রধানসহ ১১ বনদস্যু।
র্যাব জানায়, সুন্দরবনে এখনো ৬টি বাহিনী দস্যুবৃত্তিতে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে ভয়ংকর দস্যু সাগর বাহিনীর সাথে র্যাবের যোগাযোগ হয়েছে। তারাও আত্মসমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে রাজি হয়েছে। গত ৩১ মে আত্মসমর্পন করা মাস্টার বাহিনীর প্রধানসহ ১০ বনদস্যু এখন কারাগারে রয়েছেন। র্যাব-৮-এর ডিএডি মো. হাবিব বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে তাদের বিরুদ্ধে মংলা থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। তবে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়নি। তাদেরকে আর্থিক সহায়তা, জমি প্রদান ও দোকান করে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/১৫ জুলাই ২০১৬/হিমেল-০৫