রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সিটিং সার্ভিস, গেইট লক, বিরতিহীন কিংবা স্পেশাল সার্ভিস বন্ধের নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে আজ রবিবার থেকে। ফলে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে গাড়িতে যাত্রী উঠাচ্ছেন বাসের ড্রাইভার-হেলপাররা। যাত্রী টইটুম্বর না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া হচ্ছে না। অথচ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে আগের সেই সিটিং সার্ভিসের মতোই। আবার দুই/একটা গাড়ি নামে মাত্র ভাড়া ভেতরের সব জায়গা পূর্ণ হওয়ার পর গেটেও কয়েকজনকে বাদুরের মতো ঝুলিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও যাত্রীদের হয়রানি করা হচ্ছে নানাভাবে।
‘সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে সাধারণ যাত্রীদের পকেট কাটা ভাড়া এখনও আগের মতোই দিতে হচ্ছে। তাই সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় মালিকপক্ষ বেশি উপকৃত হয়েছে। সঙ্গে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ।'
সায়েদাবাদের এক যাত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমি নিয়মিত রাইদা পরিবহনে যাতায়াত করি। যখন এই আদেশ ছিল না, তখন যে ভাড়া নেয়া হতো, এখন তাই রাখা হচ্ছে। অথচ গাড়িতে গাদাগাদি করে যাত্রী উঠানো হচ্ছে।
এদিকে, সুপ্রভাত পরিবহনের যাত্রীরা জানান, এ গাড়ির কর্মীরা নিজেদের ইচ্ছামতো আইন করছে। বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া না মেনে সেই আগের মতই সিটিংয়ের ভাড়া আদায় করছে। প্রতিবাদ করলে যাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করছে।
শনিবার রাজধানীর এলেনবাড়িতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে এক বৈঠক শেষে সংস্থার চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান ঘোষণা দেন- রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ পদক্ষেপে মাঠে নামছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। বিআরটিএর এমন ঘোষণায় সায় দেয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও।
সে সময় বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান বলেন, রাজধানীতে সিটিং সার্ভিসের কোনো অনুমোদন নেই। অননুমোদিত যানবাহনের বিরুদ্ধে রবিবার থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে। শুধু সিটিং সার্ভিস বন্ধ নয়, যাত্রী হয়রানি রোধে সবধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সে অনুযায়ী আজ রবিবার থেকে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়েছে, তবে আগের সিটিং সার্ভিসে যাত্রীদের কাছ থেকে যে ভাড়া নেয়া হত সেই বাসটিই যাত্রী বোঝাই করে লোকাল হওয়ার পরও ভাড়া আগের মতোই নিচ্ছে। এতে করে যাত্রীদের ভোগান্তি আরও বেড়ে গেছে।
মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিলগামী এক যাত্রী বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়েছে ঠিকই তবে সাধারণ যাত্রীদের পকেট কাটা ভাড়া এখনও আগের মতোই দিতে হচ্ছে। তাই সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় মালিকপক্ষ বেশি উপকৃত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে একটা বাসে যে ক’টা সিট সেই সংখ্যায় যাত্রী তোলা হত, তখন মিরপুর থেকে মতিঝিলের ভাড়া রাখা হত ২৫ টাকা। এখন সিটিং সার্ভিস বন্ধ, যাত্রীও ওঠানো হচ্ছে ঠাসাঠাসি করে, সেক্ষেত্রেও ভাড়া নেয়া হচ্ছে আগের মতোই ২৫ টাকা। তাহলে সাধারণ যাত্রীদের কী লাভ হলো?'
শফিক নামে বাড্ডার এক যাত্রী বলেন, ‘বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য এসব যানবাহনের সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা আর মিনিবাসের জন্য পাঁচ টাকা নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট গন্তব্যের জন্য নির্দিষ্ট ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া আছে। কিন্তু বাস মালিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায় করছে।’
এদিকে সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণার পর আজ সকাল থেকে বেশিরভাগ রুটেই যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা কম দেখা গেছে। ফলে দীর্ঘক্ষণ যাত্রীদের বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ফলে এই সুযোগে বাসগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। এ নিয়ে বিভিন্ন পরিবহন কর্মীদের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা হচ্ছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, কিলোমিটার নয়, নিজস্ব চেক পয়েন্ট হিসাব করে আর মালিক সমিতির চার্ট দেখিয়ে এখনও সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ, ক্ষেত্রবিশেষে তিনগুণ ভাড়া আদায় করছে পরিবহনগুলো। ফলে যাত্রীদের সঙ্গে স্টাফদের বাকবিতণ্ডা, এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে।
সদরঘাট থেকে গাজীপুরগামী সু-প্রভাত পরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৭ টাকা। অথচ মিনিবাসগুলেতে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৫ টাকা।
এছাড়া আগে সদরঘাট থেকে রামপুরায় এই বাসের ভাড়া ১০ টাকা ছিল, সেখানে আজ থেকে তারা ১৫ টাকা করে নিচ্ছে। এভাবে দূরত্ব ভাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি হারে ভাড়া আদায় করছে সু-প্রভাত সার্ভিসের বাসগুলো।
একই অবস্থা পোস্তগোলা থেকে ছেড়ে আসা ছালছাবিল ও রাইদা পরিবহনে। সিটিং সার্ভিস বন্ধ করলেও সিটিংয়ে ভাড়া যেখানে তারা সর্বনিম্ন ১০/১৫ টাকা নিতো। সেখানে এখন ভাড়া নির্ধারণ করেছে ৮/১২ টাকা। একই অবস্থা সাইনবোর্ড থেকে ছেড়ে আসা অনাবিল সার্ভিসের।
গাবতলী থেকে নূর-ই মক্কা, অছিম, রবরব, আনছার ক্যাম্প থেকে ছেড়ে আসা জাবালে নূর পরিবহনগুলো সিটিং সার্ভিস বন্ধ করলেও ভাড়া প্রায় আগের মতোই রেখেছে।
এ নিয়ে যাত্রী তৌহিদ অভিযোগ করে বলেন, সরকার সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে মনিটরিং করা উচিৎ। যাত্রীরা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি থাকতে পারে না।
এদিকে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে আসা মনজিল পরিবহন, বলাকা, মতিঝিল-গুলিস্তান থেকে শতাব্দী, আজমেরী এবং সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসা প্রভাতী বনশ্রী, গাজীপুর পরিবহন সার্ভিসগুলোও তাদের সিটিং সার্ভিস বন্ধ করেছে। তবে তারা সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা থেকে ১০/১৫ টাকা করে নিচ্ছে।
এছাড়া সরকার নির্ধারিত কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৬০ পয়সা হিসেবে ভাড়া না আদায় করে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া বেশি নিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শতাব্দী পরিবহনের এক স্টাফ জানান, মালিক সমিতি বিআরটিসি থেকে ভাড়ার তালিকা এনে আমাদের দিয়েছেন, আমরা সেভাবেই কাজ করছি। এটিকে আপনারা বেশি ভাড়া বললে বেশিই নিচ্ছি, আমাদের কিছু বলার নেই।
এদিকে সকাল ৯টার দিকে তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড়ে অভিযানে এসে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধে রাজধানীতে বিআরটিএ'র অভিযান শুরু হয়েছে।
যাত্রী হয়রানি ও তাদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবহনখাতে শৃংখলা না ফেরা পর্যন্ত বিআরটিএ' র এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও আগের মতো ভাড়া নেয়া হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়েছে, তবে ভাড়া কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের হয়নি। ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নেয়া হবে। প্রতিটি বাসে ভাড়ার চার্ট থাকবে, আর যদি কোনো বাসে চার্ট না থাকে বা সে অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া না নেয়া হয় সেক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা মনিটরিং শুরু করেছি, কেউ এ সিদ্ধান্ত না মানলে আমরা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেব।’
বিডি প্রতিদিন/১৬ এপ্রিল ২০১৭/এনায়েত করিম