চট্টগ্রাম বন্দরে চাঞ্চল্যকর ১২ কন্টেইনার মদ, সিগারেট ও টিভি আটকের ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে। অস্তিত্বহীন দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল পরিমাণ আমদানি নিষিদ্ধ মদ সিগারেট আটকের ঘটনায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) অনুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দা আজ রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় এজাহার দায়ের করেছে। (মামলা নং ৫০, তারিখ- ২৭/১১/২০১৭। )এজাহার দায়ের করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বিজয় কুমার রায়। এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের মামলা উদঘাটন এই প্রথম বলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে গত মার্চ মাসের ৫ ও ৬ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি নিষিদ্ধ সিগারেট ও মদ এবং অবৈধভাবে আনা বিপুল পরিমাণ টেলিভিশনভর্তি ১২টি কনটেইনার জব্দ করেছিল শুল্ক গোয়েন্দা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসব কন্টেইনার ইনভেন্ট্রিকালে ১৬ হাজার ১৭০ বোতল মদ, ৩ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা সিগারেট, ৪ হাজার ৭৪টি এলইডি টেলিভিশন ও ২৮১টি আমদানি নিষিদ্ধ পুরাতন ফটোকপি মেশিন পাওয়া যায়।
ওই ১২টি কন্টেইনারের মাধ্যমে আনা পণ্যের ঘোষিত মূল্য ছিল ৫০ লক্ষ টাকা। কিন্তু আটককৃত পণ্যের প্রকৃত বাজারমূল্য প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা। পোল্ট্রি ফিডের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়ে এই বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়। কিন্তু কনটেইনার খুলে কোনোটিতেই ঘোষিত পোল্ট্রি পণ্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, হিনান আনহুই এগ্রো এলসি ও এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি নামের দুটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনে আমদানিকারক খোরশেদ আলম। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণায় চীন থেকে আনা চালান দুটি খালাসের দায়িত্বে ছিল সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান রাবেয়া এন্ড সন্স। চালান দুটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসার এক সপ্তাহ আগে থেকে শুল্ক গোয়েন্দার একটি দল নজরদারি শুরু করে।
আমদানিকারকও এসব পণ্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামানোর পর দ্রুত খালাস করে নেওয়ার সব প্রক্রিয়া প্রায় গুছিয়ে আনেন। তবে শুল্ক গোয়েন্দাদের কৌশলে তাদের চোরচালান পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় তা আবার ফেরত নেওয়ার জন্য বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন আমদানিকারক।
সেই আবেদন নাকচ হওয়ার পরই আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মালিক আত্মগোপনে চলে যান। চালান আটকের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মালিক পলাতক রয়েছেন।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন, (১) আব্দুল মোতালেব, (২) জালাল উদ্দিন, (৩) মোঃ আরিফুজ্জামান, (৪) মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান, (৫) মোঃ এনামুল হক, (৬) ফররুখ আহাম্মদ ও (৭) মোঃ রওশন আলম।
শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তর কর্তৃক অনুসন্ধানে দেখা যায়, উভয় প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে প্রদর্শন করে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুললেও প্রকৃতপক্ষে মূলধনী যন্ত্রপাতির পরিবর্তে বিপুল পরিমাণ মদ, সিগারেট ও টেলিভিশনসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, সিগারেটের আমদানি শুল্ক ৫০০ শতাংশ, মদের আমদানি শুল্ক প্রায় ৬০০ শতাংশ আর টিভির আমদানি শুল্ক ১৯০ শতাংশ। অথচ ঘোষিত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্ক মাত্র ১ শতাংশ। ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে ভূয়া কাগজ দিয়ে পণ্য খালাসে গ্রিন চ্যানেলের অবৈধ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা ছিলো। বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিতেই এভাবে মিথ্যা ঘোষণায় এই চালান আনা হয়েছিল।
আসামী আব্দুল মোতালেব তার নিজের নাম ও ব্যবসা পরিচয় গোপন করে জনৈক খোরশেদ আলম, গ্রামঃ পূর্বগ্রাম, বাসাঃ দক্ষিণ বেপারীবাড়ী, ইউনিয়নঃ কায়েতপাড়া, উপজেলাঃ রূপগঞ্জ, জেলাঃ নারায়নগঞ্জ এর নাম ও ছবি ব্যবহার করে মূল্য সংযোজন কর নিবন্ধন গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি নিজের ছবি ও স্বাক্ষরের স্থলে খোরশেদ আলমের ছবি ও স্বাক্ষর ব্যবহার করেছেন।
সংশ্লিষ্ট আইএফআইসি-র পল্টন শাখার ব্যাংকের কর্মরত কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও এলসি খোলা হয়েছে মর্মে অনুসন্ধানে পাওয়া যায়। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকের সাথে ভূয়া নামপরিচয় ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ব্যবসা করেছে।
শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে প্রকাশ করা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে চোরাচালানের মাধ্যমে আমদানিকৃত ১২টি পণ্য চালানের বিপরীতে শুল্ককরাদি ফাঁকি প্রদান করে মানিলন্ডারিং এর অপরাধ করেছেন।
ব্যাংকিং চ্যানেলে আমদানিকারক মূলধনী যন্ত্রপাতি হিসেবে পণ্যের দাম পরিশোধ করেছেন প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মদ, সিগারেট ও টেলিভিশনের দাম পরিশোধ করা হয়েছে অবৈধ চ্যানেলে। এই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।
মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় আনীত পণ্যের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় দি কাস্টমস্ এ্যাক্ট, ১৯৬৯ এর ২(এস) অনুযায়ী উল্লেখিত অপরাধ সুস্পষ্ট “চোরাচালান” হিসেবে সংজ্ঞায়িত এবং একই আইনের ধারা ১৫৬(১) এর টেবিলভুক্ত দফা ৮২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণা দিয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি না করে অবৈধ মদ, সিগারেট ও ইলেকট্রিক পণ্যাদি চোরাচালান করায় বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ চ্যানেলে বিদেশে প্রেরণ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) এর ধারা ২(শ) অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত মুদ্রা পাচার সংক্রান্ত অপরাধ এবং একই আইনের ধারা ৪ ও ৮ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বর্ণিতাবস্থায়, আসামিদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) এর ধারা- ৪ ও ৮ এ একটি নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়।
উল্লেখ্য, এই ঘটনার সংশ্লিষ্ট আইএফআইসি ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দরের আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তদন্তকালে অন্য কোন ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা আইনি আমলে আনা হবে।
উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সময়ের প্রয়োজন হওয়ায় এজাহার দায়ের করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বলে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) অনুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কর্তৃক আলোচ্য মামলার পরবর্তী তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ১২ কন্টেইনার পণ্য আটকের আগেও একই আমদানিকারক একই ব্যাংকের মাধ্যমে আরও ৭৮টি কন্টেইনার একইরকম মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণায় আমদানি করে খালাস নিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলোতেও অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি করা হয়েছে যার বাজারমূল্য প্রায় ১০৫০ কোটি টাকা।
বিডি প্রতিদিন/২৭ নভেম্বর ২০১৭/হিমেল