প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সংঘাতমুক্ত সমাজ গড়তে বিশ্ব শান্তি ও নারীর ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকারের মূল দর্শনই হচ্ছে মানবিক উন্নয়ন অর্জনে নারী-পুরুষ হাতে হাত ধরে কাজ করবে। কেননা জাতি হিসেবে আমাদের যাত্রায় নারীরা সমান অংশীদার। উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন কখনোই সম্ভব নয়।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের রাণী এলিজাবেথ কনফারেন্স সেন্টার-২ এ কমনওয়েলথ উইমেন ফোরাম আয়োজিত ‘ক্ষমতায়নে শিক্ষাঃ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে নারীর জন্য গুণগতমানের প্রাথমিক শিক্ষা ও বাস্তবভিত্তিক মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সমতা আনয়ন’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে’র আমন্ত্রণে ১৭ থেকে ২১ এপ্রিল ২৫তম কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সোমবার স্থানীয় সময় রাত পৌনে একটায় সৌদি আরব থেকে লন্ডন পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। সফরের প্রথম দিনেই প্লেনারি সেশনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন ছাড়াও ব্যস্ত সময় কাটান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথভুক্ত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নারীর অবদানের কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের অগ্রযাত্রায় নারীরা সমান অংশীদার। আমাদের নারীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাই বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে লিঙ্গ সমতা এবং মৌলিক অধিকারে সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সবক্ষেত্রে নারী ক্ষমতায়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর সমতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অগ্রপথিক। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী নারীর ক্ষমতায়নে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ১৫৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব না। নারী শিক্ষার্থীদের গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের সরকার একগুচ্ছ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
প্ল্যানারি সেশন শেষে সম্মেলন স্থলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক সহায়তা বিষয়ক মন্ত্রী পেনি মরড্যান্ট এমপি। বিকালে যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংস্থা ওডিআই আয়োজিত ’বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি : নীতি, অগ্রগতি ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় নৈশভোজেও অংশ নেন তিনি।
সফরকালে আগামীকাল বুধবার এশীয় নেতাদের অংশগ্রহণে ’ক্যান এশিয়া কিপ গ্রোইং?’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মে আয়োজিত অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান ও নৈশভোজে যোগ দেবেন। আগামী বৃহস্পতিবার কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের বৈঠকের উদ্বোধনী ও অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি। এছাড়া কমনওয়েলথ মহাসচিবের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠান এবং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেওয়া নৈশভোজেও প্রধানমন্ত্রীর অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
আগামী শুক্রবার সম্মেলনের সমাপনী কার্যনির্বাহী অধিবেশনে অংশ নেওয়ার পরদিন শেখ হাসিনা রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটি (আরসিএস) আয়োজিত সংবর্ধনা এবং ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে। শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম মেহের আফরোজ চুমকিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। আট দিনের এই সফর শেষে আগামী ২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের দু’মেয়াদে নারী শিক্ষার উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের সরকার বাংলাদেশে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করে দিয়েছে। এছাড়া ২ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন শিশুর জন্য স্কুলে খাদ্য কর্মসূচি চালু করেছে। আর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, আমাদের সরকার ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এ বছর রেকর্ড সংখ্যক ৩৬২ মিলিয়ন পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে যেখানে স্কুলগামী মেয়েদের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩৫ শতাংশ, তা আমাদের সরকারের সময় বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৭৩ শতাংশে। শিক্ষার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৩ শতাংশ হয়েছে। আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০০৯ সাল থেকে ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমান সংসদের ২২ জন নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। আর সম্ভবত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদই বিশ্বের মধ্যে একমাত্র সংসদ যেখানে স্পিকার, সংসদ নেতা, বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা চার জনই নারী। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ৩০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক উত্পাদনশীলতা, সামজিক ও মানবিক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে আমরা ২০১০ সালের শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছি। প্রথমবারের মতো আমাদের সরকার এক বছরের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। আমাদের মোট জনসংখ্যা ৬০ শতাংশ তরুণ। তাদেরকে ভবিষ্যতের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ এবং গ্রামীণ নারীদের জীবনমান উন্নয়নে নারী শিক্ষা ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পারিবারিক ও শোষণের ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। নারী শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বাল্যবিবাহ হ্রাসে ব্যাপক অবদান রাখছে। এছাড়া উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি অর্জনের কথা তুলে ধরে বলেন, গত মাসে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। এ অর্জনে বাংলাদেশই প্রথম এ স্বীকৃতি অর্জনে প্রদত্ত তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দূরদর্শন হচ্ছে মানবিক উন্নয়ন অর্জনে নারী-পুরুষ হাতে হাত ধরে কাজ করবে।
বিডি-প্রতিদিন/১৭ এপ্রিল, ২০১৮/মাহবুব