২০ অক্টোবর, ২০২১ ০৮:৩৩

ভয়ংকর হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া

জিন্নাতুন নূর

ভয়ংকর হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া

প্রতীকী ছবি

অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি থেকে শুরু করে কিডনি বিক্রির মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটনে এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে অপরাধীরা। সম্প্রতি দেশব্যাপী ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে উসকানিমূলক কনটেন্টও ছড়ানো হয়। এ ছাড়া ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষকে বিব্রত করার ঘটনা সমাজে ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমকে এখন কিছু মানুষ প্রতিশোধ নেওয়ার মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করছে। আগে যেখানে মারামারি করে মানুষ তার রাগ কমাত এখন এর বদলে অপরাধীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আরেকজনকে বিব্রত করছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, একজনকে যখন কেউ কোনোভাবে নির্যাতন করতে চায় তখন কোনো না কোনো মিডিয়ার প্রয়োজন হয় আর এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এর অন্যতম কারণ সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে অপরাধী তার নিজের পরিচয়ও গোপন রাখতে পারে।

১৭ অক্টোবর বিজ্ঞান ইউনিটের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্র করে পরীক্ষার প্রশ্ন ও সাজেশন বিক্রির পোস্টে সয়লাব ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। আর এসব পোস্টের ফাঁদে পড়ে কোনো কোনো শিক্ষার্থী টাকা খুইয়েছেন। জানা যায়, ভর্তি পরীক্ষা শুরুর ঠিক এক দিন আগে গুচ্ছ পরীক্ষাভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের পোস্টে ঘুরেছে সাজেশন এবং প্রশ্নপত্র দেওয়ার বিজ্ঞাপন। শিক্ষার্থীদের শতভাগ নিশ্চয়তার প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা। এমনকি প্রশ্নপত্র ও সাজেশন পেতে শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জারের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এমন এক ভুক্তভোগী তাইজুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, তিনি ও তার কয়েক বন্ধু সাজেশন পাওয়ার জন্য একটি গ্রুপে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সেই গ্রুপের সদস্যরা তাদের একজনকে ব্লক করে দিয়েছে শুনে তাইজুল কথা বলতে চেষ্টা করলে তাকেও ব্লক করে দেয়। এর ফলে তাইজুলরা সাজেশন ও টাকা কিছুই পাননি। প্রশ্নপত্র ও সাজেশন দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ‘তাহসিন আব্রাহাম রোসেন’ নামে ফেসবুকের একটি ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে পোস্ট

দেওয়া হয়। সেই পেজ থেকে বলা হয়, ‘এ’ ইউনিটের প্রশ্নের জন্য ৪০ হাজার টাকা লাগবে। এজন্য উচ্চমাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডের ছবি, অভিভাবকদের ফোন নম্বর এবং ৫০ ভাগ টাকা জমা দিয়ে সিক্রেট কিউ গ্রুপে যুক্ত হতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন উসকানি ও অপব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ফেনী থেকে সম্প্রতি তিনজনকে আটক করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নাশকতার উসকানি দিতে আটক যুবকরা বিভিন্ন কনটেন্ট ছড়িয়ে আসছিল। এ ছাড়া সম্প্রতি কুমিল্লায় পূজামন্ডপের অপ্রীতিকর ঘটনা কেন্দ্র করে ফেসবুক ও ইউটিউবে উগ্রবাদী কথা যুক্ত করে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গোলাম মাওলা (২৬) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। জানা যায়, আটক যুবক ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করেন। ১৩ অক্টোবর ঘটনার দিন তিনি নানুয়ার দীঘির পাড় পূজামন্ডপের বিভিন্ন ছবি সংগ্রহ করেন। এসব ছবিতে উগ্রবাদী কথা যুক্ত করে নিজের ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেলসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার সংঘবদ্ধ এক চক্রকে সম্প্রতি শনাক্ত করেছে র‌্যাব। জানা যায়, চক্রটি এরই মধ্যে শতাধিক ব্যক্তির কিডনি বিক্রি করেছে। চক্রের সদস্যরা একেকটি কিডনি ২ লাখ টাকায় কিনে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করত। একই চক্রের অন্য সদস্যরা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য গ্রহীতার কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিত। অভিযান চালিয়ে এ চক্রের অন্যতম হোতা ও ফেসবুক পেজটির অ্যাডমিন মো. শাহরিয়ার ইমরানসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা অনলাইনে প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও দাতাদের আকৃষ্ট করছে এবং নিজেদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়া ফেসবুকে ট্রাভেল গ্রুপ খুলে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সম্প্রতি এ ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। ‘লঞ্চ ভ্যাসেল ফাইন্ডার্স বাংলাদেশ’ নামে একটি ফেসবুক ট্রাভেল গ্রুপের সঙ্গে ভ্রমণকারীরা ভ্রমণে গিয়ে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলে একপর্যায়ে ‘আমাজন’, ‘ইবে’র মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে যৌথভাবে ব্যবসার প্রস্তাব দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন গ্রুপটির সদস্যরা। সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ এ প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে মাত্রাহীন হয়রানি ও সাইবার অপরাধ চলছে। হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। নারী-শিশু থেকে শুরু করে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের টার্গেট করে হয়রানি করছে সাইবার অপরাধীরা। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউবের মতো মাধ্যমগুলোকে বেপরোয়াভাবে সাইবার অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামাঞ্চলে হওয়া বিচার-সালিশের বড় একটি অংশই ফেসবুক অ্যাকাউন্টকেন্দ্রিক। দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে আপত্তিকর ব্যক্তিগত কনটেন্ট শেয়ার করা হচ্ছে, তা অন্যরা দেখে ফেলায় ভুক্তভোগী বিব্রত হচ্ছেন।

প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারী ও শিশুদের আমাদের দেশে সামাজিকভাবে হেয় করা সহজ। অনলাইনে পুরুষ ও ছেলেদের তুলনায় নারী-শিশুকে আক্রমণ করাও সহজ। বিশেষ করে ডিজিটাল মিডিয়ায় এটি আরও সহজ হয়ে গেছে। কারণ এর টুলগুলো এখন সহজলভ্য। তবে অপরাধীরা মানসিক অসুস্থতা থেকেই এ ধরনের অপরাধ করছে। দেখেছি যে আগে থেকে শত্রুতাবশত সমাজে একজন আরেকজনকে হেয় করে প্রতিশোধ নিত। ডিজিটাল মিডিয়ায় সে কাজটি আরও সহজ হয়ে পড়ায় সাইবার অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একজনকে যখন কেউ কোনোভাবে নির্যাতন করতে চায় তখন কোনো না কোনো মিডিয়ার প্রয়োজন হয়। আর এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া এখন জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এর মাধ্যমে অপরাধী তার নিজের পরিচয়ও গোপন রাখতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে একজন অপরাধী তার নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে অন্যকে বিব্রত করে। এ অপরাধীদের মধ্যে স্বল্প কিছুসংখ্যক হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের সুস্থ করতে অন্য রকম ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন। কিন্তু বেশির ভাগ অপরাধীকেই মানসিকভাবে অসুস্থ মনে করার কারণ নেই।’

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীর আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে তাকে ব্ল্যাকমেল করা সাইবার ক্রাইমের নতুন একটি ধরন। একে বলা হয় ‘সেক্সটোরশন’। এর মাধ্যমে একজনের আপত্তিকর ছবি দিয়ে যৌন হয়রানির নামে চাঁদাবাজি করা হয়। আর টাকা না দিতে চাইলে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা এর ফাঁদে পড়ে। ইন্টারনেটে এ ধরনের অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের বছর বছর মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকতে হয়। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, সোশ্যাল প্ল্যাটফরমের যে আপত্তিকর পোস্টগুলো ভাইরাল হচ্ছে, বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে একটা বড় অংশই ভুক্তভোগী হচ্ছে শুধু ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার কারণে। একটি সোশ্যাল প্ল্যাটফরম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাইরের দেশে যে নীতি ও নৈতিকতা ব্যবহার করা হয়, বাংলাদেশে তা করা হয় না। আবার তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে ছেলেমেয়েরা যেহেতু সবাই ডিভাইস দ্বারা সংযুক্ত, এজন্য এসব ডিভাইস তারা কী কাজে ব্যবহার করছে তা নজরদারি করতে হবে এবং তাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার বিষয়টিকে একটি টাইম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে আনতে হবে। কিংবা প্যারেন্টাল কন্ট্রোলসহ যে ব্রাউজার আছে তা ব্যবহার করার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহী করতে হবে। তবে পুলিশের প্রযুক্তিগত সুবিধা এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। সাইবার অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থাগুলো থেকেও অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সদস্যরা।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর