কোনো কিছু পাওয়ার পর কিংবা কোনো কিছু খাওয়ার পর আমরা সাধারণত আলহামদুলিল্লাহ বলি। এর বাইরেও বলি। কোনো সুসংবাদ, রোগমুক্তি কিংবা অন্তর শীতল করা আবেগ-অনুভূতির ক্ষেত্রেও আলহামদুলিল্লাহ বলি। এটি একটি কোরআনিক শব্দ, যার অর্থ সব প্রশংসা আল্লাহর। কোনো নিরীশ্বরবাদী যদি প্রশ্ন করেন কেন আপনি আলহামদুলিল্লাহ বলবেন? কারণ সবকিছুই তো আপনি অর্জন করেছেন নিজস্ব পরিশ্রমের বিনিময়ে অথবা আপনার মতো অন্য কোনো মানুষের দয়া-করুণা কিংবা অনুকম্পার কারণে। কম জানা দুর্বল ইমানের লোকজন বুদ্ধিমান নিরীশ্বরবাদীর দ্বারা যে কোনো সময় বিভ্রান্ত হতে পারেন। আর সে কারণে সচরাচর ব্যবহৃত খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলে অনেক ফেতনা-ফেসাদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
আলহামদুলিল্লাহ বুঝতে হলে সবার আগে দরকার আলহামদু শব্দটির অর্থ, উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য জানা। পরে আপনাকে জানতে হবে রব এবং আলামিন শব্দের অর্থ। আলহামদু বলতে সেই প্রশংসাকে বোঝানো হয় যা নিয়ামতের কারণে জ্ঞাপিত হয়। আর নিয়ামত হলো সেসব পুরস্কার, দান কিংবা অনুদান যা বান্দা তার মালিক দীন-দুনিয়ার বাদশাহ আল্লাহর পক্ষ থেকে জন্মসূত্রে বা কর্মসূত্রে লাভ করে। নিয়ামতগুলো কখনো দেখা যায় আবার কখনো দেখা যায় না; কখনো স্পর্শ করা যায় আবার কখনো যায় না- হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। নিয়ামতের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও প্রশংসা হারাম। আল্লাহর নিয়ামত সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে হলে আপনার থাকতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানময় একটি মন, বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক এবং প্রচুর জ্ঞান।
পবিত্র কোরআনের সুরা ইবরাহিমের ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, 'তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গুনে শেষ করতে পারবে না'। মানুষ সাধারণত এসব খোঁজাখুঁজির তোয়াক্কা করে না। আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতকে নিজের প্রাপ্য কিংবা পরিশ্রমলব্ধ বা অন্য কোনো মানুষের অনুগ্রহ মনে করে তারা হয় নির্বিকার থাকে, নয়তো অহংকারী হয়ে পড়ে কিংবা অন্য কোনো বান্দার কাছে মাথা নুইয়ে আত্মসমর্পণ করে। আর এ কারণেই এ আয়াতের পরবর্তী বাক্যে আল্লাহ বলেন, 'মানুষ বড়ই জালিম, অকৃতজ্ঞ'। কোন জালিম কোন অকৃতজ্ঞ তা বোঝার জন্য আয়াতের প্রথম বাক্যটি পড়তে হবে। আল্লাহ বলেন, 'আর যিনি তাঁর নিকট চাওয়া প্রতিটি বস্তু দিয়ে দিলেন'। আয়াতের এ অংশের ব্যাখ্যায় বলা যায় মানুষ তার রবের দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলে রব তা মঞ্জুর করেন। কিন্তু অকৃতজ্ঞ এবং জালিম প্রকৃতির মানুষ আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্তির পর তা বেমালুম ভুলে যায়।
বুদ্ধিমান মানুষ আল্লাহর নিয়ামত সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য প্রথমে নিজ সত্তার প্রতি মনোযোগী হয় এবং সতর্ক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করে। মানুষের সত্তার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। একটিকে বলা হয় দেহ এবং অন্যটি হলো আত্মা। দুর্ভাগ্য সেই মানুষের যে আত্মার ওপর শরীরকে প্রাধান্য দেয় এবং শরীরের ভোগবিলাসের জন্য আত্মার ওপর জুলুম করে কিংবা আত্মাকে মেরে ফেলে। কোনো মুমিন বান্দা শরীরকে আত্মার ওপর প্রাধান্য দেন না। তারা আত্মাকে পবিত্র রাখার জন্য সব সময় শরীর ও মনকে (নফ্স) নিয়ন্ত্রণ করেন। মুমিন তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে তাকান এবং দেহের ভিতর চলমান প্রায় পাঁচ হাজার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নেন। তিনি ভাবেন কীভাবে শরীরের মধ্যে স্থাপিত ওষুধের কারখানাটির হাজারো রুহানি ওষুধ তার বিষ, ব্যথা, কাটাছেঁড়া কিছুটা ভালো করে দেয় অথবা ভাঙা হাড়গুলোকে জোড়া লাগিয়ে দেয়। নিজের শরীরের লাখো-কোটি কোষ কিংবা একটি কোষকে কেন্দ্র করে তৈরি একেকটি নিউক্লিয়াস এবং সেই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের খেলার কাহিনী বান্দাকে রবের প্রতি কৃতজ্ঞ না করে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো, বান্দার প্রতি আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামতগুলোর মধ্যে কোনটিকে প্রাধান্য দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হবে? আমার মতে জাগতিক বিষয়গুলোর যেসব ঘটনা, উপকরণ এবং উপাদান সহজে দেখা যায়, বোঝা যায় কিংবা অনুভব করা যায় সেগুলোকে স্মরণে এনে আলহামদুলিল্লাহ বললে হৃদয়-মন খুব সহজেই আল্লহর প্রতি মোতাওয়াজ্জু হয়ে পড়ে। স্বয়ং আল্লাহও তদ্রূপ নির্দেশ দিয়েছেন আল কোরআনে। সুরা দোহার ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, '(হে নবী) আমি কি আপনাকে ইয়াতিম হিসেবে আশ্রয় দান করিনি!' পরবর্তী আয়াতগুলোয় আল্লাহ বলেন, 'তিনি আপনাকে পথহারা হিসেবে পেয়েছেন, এরপর পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন।' এ সুরার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, 'আপনার পালনকর্তার নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন'।
উপরোক্ত আয়াতগুলোয় আল্লাহ তার রসুল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বললেও তিনি মূলত মানবমণ্ডলীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য। জীবনের শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে যেসব ঘটনা সহজেই দাগ কাটে সেগুলো স্মরণ করার জন্য ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতিম হিসেবে জন্মের পর রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মা এবং দাদার মৃত্যুতে অনেকটা পথহারা পথিকের মতো চাচা আবু তালিবের কাছে আশ্রয় নেন। এ সময় থেকে উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে ব্যবসা শুরুর আগ পর্যন্ত প্রাত্যহিক জীবনের দারিদ্র্য তাকে বার বার আঘাত করতে থাকে। সব শেষে তার আশ্রয়দাতা আবু তালিবের মৃত্যুর পর তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েন। রসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং অল্প দিনের মধ্যে মক্কাসহ সমগ্র হিজাজ, ইয়েমেন, নুফুদ, হাইল, নজদ প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে একজন ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তখন জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, অর্থবিত্ত ও ক্ষমতা তার পায়ের কাছে চলে এলো। জীবনের এ সুখময় ক্ষণে তিনি সব সময় তার অতীত জীবনের সফল স্মৃতি বার বার স্মরণ এবং তার প্রতি প্রদত্ত আল্লাহর নিয়ামতের স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে তার উম্মতের জন্য অনুকরণীয় এবং পালনীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
আপনার প্রাত্যহিক জীবনের অসংখ্য ঘটনা স্মরণ করে আপনি আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারেন। খুব ভোরে আপনি যখন ঘুম থেকে ওঠেন তখনো আপনার চোখে ঘুমের রেশ থাকার কারণে চোখ দুটি খুলতে হয়তো একটু দেরি করেন। কিন্তু ততক্ষণে আপনার দেহের পেশিগুলো ধীরে ধীরে সচল হয়ে গেছে, আপনার মস্তিষ্কও কাজ করতে শুরু করেছে। এ সময় আপনি সাধারণত একটু গড়াগড়ি করেন। তারপর গতকালের ঘটনা স্মরণ করেন। এরপর আজকের দিনের করণীয় নিয়ে মস্তিষ্ককে তৎপর করেন। যদি আপনার তাড়া থাকে তবে তিড়িং বিড়িং লাফ মেরে আপনি বিছানা থেকে উঠে পড়েন। আর আপনার যদি হতাশা কিংবা কাজের কোনো তাড়া না থাকে তবে শুয়ে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে দিতে আকাশকুসুম কল্পনায় আপনি বহু হাতি-ঘোড়া মেরে রাজা-উজিরের বারটা বাজিয়ে হাপিত্যেশ করতে থাকেন। এ অবস্থায় নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে চোখ খোলার আগে আপনি কয়েকটি বিষয় চিন্তা করুন। আপনি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন কার্যত আপনি ছিলেন মৃত। জাগ্রত হওয়ার আগে আল্লাহ দয়া করে আপনার রহটি আপনাকে ফেরত দেন। দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ মানুষের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয় ঘুমন্ত অবস্থায় এবং ভোর রাতের দিকে। অন্যদিকে কিয়ামত সংঘটিত হবে ভোররাতে। কাজেই ঘুম থেকে জেগে আপনি যদি আল্লাহকে ধন্যবাদ দেন রুহুটি ফেরত দেওয়ার জন্য এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন হার্ট অ্যাটাক কিংবা কিয়ামতের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সেদিনের মতো বেঁচে যাওয়ার জন্য, তখন দেখবেন আপনার অন্তর আল্লাহর নুরে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ঘুম থেকে উঠে অজু করেন। তারপর নামাজ পড়ে নিজের সব দুঃখ-কষ্ট-যাতনা, চাওয়া-পাওয়া, পরিকল্পনা, আশা-আশঙ্কার কথা আপনার মাতৃভাষায় বিনয়ের সঙ্গে সুন্দর সুন্দর শব্দমালা দিয়ে আল্লার কাছে উপস্থাপন করুন কখনো উচ্চৈঃস্বরে আবার কখনো নিম্নস্বরে কিংবা ফিসফিসিয়ে। আপনার এ মোনাজাতের ধরন হবে এমন যেন মহান আল্লাহ পরম বন্ধুরূপে আপনার সামনে রয়েছেন। আপনি আপনার মালিককে বলুন, প্রাণ খুলে বলুন, আবদারের সুরে এমনভাবে বলুন যা আপনি দুনিয়ার কাউকে বলতে পারেন না। দেখবেন বলতে বলতে আপনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, আপনার অন্তরের সব বেদনা পানি হয়ে আপনার নাক-চোখের অশ্রু হয়ে যাবে। আপনি হয়ে পড়বেন প্রশান্তচিত্তের কৃতজ্ঞ এবং আত্মপ্রত্যয়ী একজন মানুষ।
মোনাজাত শেষ করে আপনি কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। প্রশান্ত মন নিয়ে আপনি চলে যান বেলকনিতে কিংবা ছাদে। এবার আকাশের দিকে তাকান। তারপর চারদিকটায়। কিছু পাখিকে দেখবেন উড়তে। আপনার কানে ভেসে আসবে হরেকরকম পাক-পাখালির ডাক। এরপর আপনার দৃষ্টি জমিনে নামিয়ে আনুন। আশপাশের বৃক্ষ-তরুরাজি, মাটি ও মানুষের দিকে তাকান এবং পুনরায় আসমানের দিকে তাকিয়ে বলুন, আহ! দুনিয়াটি বড়ই সুন্দর যেন একটি আনন্দ ভুবন। আপনার চোখ, কান এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কথা স্মরণ করুন যা না হলে পৃথিবীর সব রূপ, রস, গন্ধ আপনার অজানা থেকে যেত। সর্বশেষে নিজের মনকে বিনয়ী করুন, আপনার মালিককে ভালোবাসুন এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে বলে উঠুন আলহামদুলিল্লাহ।
প্রাত্যহিক জীবনের সব কাজ শুরুর আগে নিজেকে সাজান। শেভ, গোসল ইত্যাদি সারার পর পোশাক পরিবর্তন করে একটু আয়নার সামনে দাঁড়ান। মাত্র দু-তিন মিনিট। একটু সাজগোজ করুন। এ সময় গুনগুন করে প্রিয় কোনো গানের কয়েকটি লাইনে সুর তুলতে পারেন অথবা কোরআনের কোনো আয়াতে সুর তুলে তিলাওয়াত করতে করতে নিজেকে সজ্জিত করতে গিয়ে কেবল নিজের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবুন। নিজেকে দেখুন এবং বলুন, আমি এক অনন্য মানুষ। আমি আল্লাহর দয়া, সাহায্য এবং করুণাপ্রাপ্ত একজন বান্দা; আল্লাহ আমায় ভালো রেখেছেন; অনেকের চেয়ে ভালো রেখেছেন- আলহামদুলিল্লাহ।
সকালের নাস্তার টেবিলে বসে আপনি টেবিলের খাবারের দিকে তাকান। স্মরণ করুন এই খাদ্যের জন্য অনেক মা সন্তানকে বিক্রি করে দেন, অনেক স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে যান, অনেক স্বামী-পিতা ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। এই সময়ে আপনি ফোনে কথা বলবেন না। স্ত্রী-সন্তান বা কাজের লোকের ত্রুটি খুঁজবেন না এবং দিনের কর্মসূচি ভেবে পেরেশান হবেন না। সময় নিয়ে নাস্তা করুন এবং খেতে খেতে একটু চোখ বুজে খাবার স্বাদ অনুভবের চেষ্টা করুন। আল্লাহকে স্মরণ করুন এবং মনে মনে বার বার আলহামদুলিল্লাহ বলুন।
ঘর থেকে বের হওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকান, তাদের জন্য অন্তরটি মহব্বতে পূর্ণ করুন। তারা সবাই আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য নিয়ামত। তাদের ত্রুটিগুলো ভুলে যান এবং ভাবুন আপনি তাদের ভালোবাসেন এবং তারাও আপনাকে ভালোবাসে। আপনারা একে অন্যের সাহায্যকারী, আনন্দলোকের সঙ্গী এবং বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সময় সাহায্যকারী। তারপর সালাম বিনিময়ের পর বিসমিল্লাহ বলে ঘর থেকে বের হন। বের হওয়ার আগে এক নজরে আপনার ঘরটি দেখুন। পরিবারের সদস্যদের দেখুন এবং মনে মনে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ। আশা করা যায় আল্লাহর রহমত ও বরকতের চাদরে আপনি মোড়ানো থাকবেন। কোনো সফলতার পেছনে আপনাকে ছুটতে হবে না। বরং সফলতাগুলো ভিক্ষুকের মতো বার বার আপনার কদমে আছড়ে পড়বে আর আপনি সে দৃশ্য দেখে বলে উঠবেন- আলহামদুলিল্লাহ!
লেখক : কলামিস্ট