২৮ মার্চ, ২০২০ ১৪:০৫

পরাগের মায়ের মৃত্যু এবং...

আরিফুর রহমান দোলন

পরাগের মায়ের মৃত্যু এবং...

আরিফুর রহমান দোলন

পরাগের আম্মা আকস্মিকভাবে মারা গেছেন গত বৃহস্পতিবার। জানাজা, দাফনে অংশ নিতে পারিনি। তীব্র এক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আপনজনের বিপদে-আপদে মানুষ আপনজনকে পাশে আশা করে। এটাই স্বাভাবিক। আর মাতৃবিয়োগের চেয়ে বড় বিপদ আর কি-ই বা হতে পারে! এমন এক সময়ে পড়ে রয়েছি রাজধানী ঢাকায়। কার্যত বাধ্য হয়ে। এযাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস জনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে ও রাখতে কোয়ারেন্টাইনে থাকছি। বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছায়, পরিজনের অনুরোধে এবং সরকারের উপর্যুপরি পরামর্শে। দুঃসময়ে পরাগের পাশে থেকে তাকে সঙ্গ দিতে পারলাম না। নিজেকে ব্ড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। 

নুরুদ্দীন পরাগ আমাদের খুব ভালো একজন কর্মী। কাঞ্চন মুন্সী ফাউন্ডেশন নিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যখন দিনের পর দিন পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি, সব সময় পরাগ আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। এরপর একজন ভাল রাজনৈতিক কর্মী হয়েও উঠেছে। যখনই গ্রামে যাই তখন আলফাডাঙ্গা উপজেলার হিদাডাঙ্গা গ্রামের পরাগ ছুটে আসে। কারণে, অকারণে সঙ্গ দেয় দীর্ঘ সময়। সেই পরাগের মায়ের মৃত্যুতে তার পাশে না থাকতে পারার যে যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর করে দিল তা তো ওই করোনাভাইরাসই। 
তবে কি করোনাভাইরাস আমাদের অসামাজিক করে দিচ্ছে? গোটা বিশ্বে মহামারি ঠেকাতে বিচ্ছিন্নকরণ পদ্ধতি একটি সাময়িক উপায় হয়তো। হতে পারে। কিন্তু এটি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়? তাহলে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। শুধু কি অর্থনীতি ভেঙে পড়বে? সামাজিক সম্পর্কও ভেঙে চুরমার হবে। পারস্পরিক অবিশ্বাস চরম আকার ধারণ করবে। 

তাই পারস্পরিক বিচ্ছিন্নকরণের পরিবর্তে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে হবে। 
করোনাভাইরাস কোথা থেকে এলো? কে বা কারা এর জন্য দায়ী? গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের কারণেই এই রোগ ছড়াচ্ছে, এমন অভিযোগ রয়েছে। একারণে অবিশ্বায়ন বা ‘দেয়াল তোলা’ নীতি নেওয়ার পক্ষে একটা জনমত সৃষ্টির চেষ্টাও আছে। কিন্তু বিশ্বায়ন সীমিত করে সংক্রমণ রোগ থেকে বাঁচা কি আদৌ সম্ভব? মোটেও না। বরং নিরন্তর তথ্য আদান-প্রদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের থেকে বিশ্বকে বাঁচানো বেশি সহজ। 

মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এর আগেও একাধিকবার হয়েছে। ইতিহাস বারবার সেই সাক্ষ্য দেয়। একসময় গুটিবসন্ত গোটা বিশ্বেই আতঙ্কের নাম ছিল। ১৫২০ সালে মধ্য আমেরিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া গুটিবসন্ত রোগে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর ভয়াবহ ‘ফ্লু’ আসে ১৯১৮ সালে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মাত্র কয়েক মাসেই ‘ফ্লু’ ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত হয় পৃথিবীর অর্ধশত কোটি মানুষ। প্রায় ১০ কোটি মানুষের প্রাণহানি হয় ‘ফ্লু’তে। এরপর তা নিয়ন্ত্রণে আসে। 

পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। বিশেষত, পরিবহন ব্যবস্থা এখন এত উন্নত যে নিমিষেই এক দেশের নাগরিক আকের দেশে যেতে পারেন। অত্যাধুনিক, আধুনিক শহরে তাই জীবাণুর সহজ প্রবেশ খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন যত বেশি হবে বিশ্বও ততো অরক্ষিত হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। এরকম একটি অরক্ষিত, দুর্বিষহ পৃথিবীতেই এখন আমাদের বসবাস। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে, সুরক্ষিত রাখতে আমাদের নিতে হবে বহুমুখী পদক্ষেপ। বিশেষত, তথ্য আদান প্রদান আর পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। 

যেকোনো মহামারির বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধই এর বিরুদ্ধে বাঁচার উপায় হতে পারে। পরস্পর তথ্য বিনিময় করে জীবাণু গবেষক, চিকিৎসকরা মহামারি ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক বিভিন্ন সময় আবিষ্কার করেছেন অতীতে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতেও তা করবেন এটিই আমাদের আশা। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী সবাই মিলে একযোগে কাজ করে সারা দুনিয়ার মহামারির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণা করেছেন বলেই মাত্র দুই সপ্তাহে করোনাভাইরাস সম্পর্কে গোটা বিশ্ব জানতে পেরেছে। বিজ্ঞানীরা এই নতুন ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করতে পেরেছে এবং ভাইরাস আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত করার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও রপ্ত করে ফেলেছে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকও অতি দ্রুত আবিষ্কার হয়ে আমাদের ব্যবহার উপযোগী হবে- এই আশা আমরা তাই করতেই পারি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে বিশ্বব্যাপী গুটিবসন্ত নির্মূলের ঘোষণা দেয়। অথচ আর এক দশক আগেই ১৯৬৭ সালে প্রায় দেড় কোটি মানুষ গোটা দুনিয়ায় গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মৃত্যু হয় ২০ লাখ লোকের। এরপর আবিষ্কৃত হয় গুটিবসন্তের টিকা। ৫৪১ সালে গোটা দুনিয়ায় জাস্টিনিয়ান প্লেগ ভয়াবহ আকারে আসে এবং ৫ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। তখন বিশ্বের জনসংখ্যাই ছিল ১০ কোটি। এই সময়ে যারা বেঁচে ছিলেন তারা নাকি মূলত বিচ্ছিন্নকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করেই ইতিবাচক ফল পান। জাস্টিনিয়ান প্লেগের ৮০০ বছর পর আবার প্লেগের প্রকোপ শুরু হয় দুনিয়া জুড়ে। ১৯৪৭ সালে এটি ইউরোপে আঘাত হানে। পরে চার বছরে অন্তত ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এই মহামারিতে। ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে এই প্লেগ মানুষকে অনেক ভুগিয়েছে। উপর্যুপরি গবেষণা, তথ্য আদান-প্রদান আর বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় এই মহামারির বিরুদ্ধেও মানুষের জয় হয়েছে। তবে তখনও আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিয়ম চালু করে অনেক সুফল পাওয়া গেছে। যদিও ব্ল্যাক ডেথের পরবর্তী ৩০০ বছর ধরে নির্দিষ্ট সময় পর পর প্লেগের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ইংল্যান্ড। 

কলেরা, ম্যালেরিয়া, ইবোলা, ডেঙ্গু কি আমাদের কম ভুগিয়েছে? কিংবা চিকনগুনিয়া? ১৮১৭ সালে রাশিয়ায় মহামারি আকারে শুরু হওয়া কলেরা পরবর্তীতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে যায় এবং অন্তত ২০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। পরবর্তীকালে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি এবং প্রতিষেধক আবিষ্কার করে একে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। উন্নত বিশ্বে কলেরা নির্মূল হলেও অনুন্নত দেশগুলোতে এখনো তা রয়ে গেছে। কারণ পর্যাপ্ত স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ খাবার পানির পুরোপুরি ব্যবস্থা করতে না পারা। 

তবে সকল মহামারির বিরুদ্ধেই মানুষ লড়ছে। আর মূল শক্তিই হলো একতা। একে অপরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা। সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে, তথ্য গোপন করে, বৈশ্বিক যোগাযোগ শিথিল করে মহামারির প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। ‘আইসোলেশন’, ‘কোয়ারেন্টিন’ কি দীর্ঘায়িত করা সম্ভব? তাহলে তো মধ্যযুগ কিংবা প্রস্তর যুগে ফেরত যেতে হবে আমাদের। সেটা কি আদৌ সম্ভব? 

বরং আমাদের উচিত হবে আরো মানবিক হওয়া। বিপদগ্রস্তদের পাশে আরো বেশি করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। বৈশ্বিক সাহায্য-সহযোগিতা, পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সুরক্ষা অর্জন বেশি সহজ বলেই আমার মনে হয়। যেমন, যে দেশ মহামারিতে বেশি আক্রান্ত তার উচিত তথ্য গোপন না করা। আর যেসব দেশ কম আক্রান্ত তার উচিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পাশে সবভাবে দাঁড়ানো। সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব বৃদ্ধিই হতে পারে এখন সবচেয়ে বড় শক্তি। আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর বিচ্ছিন্নতার নীতি থেকে সরে আসি সবাই। এই হোক করোনা ভাইরাস থেকে আমাদের শিক্ষা। 

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

সর্বশেষ খবর