২ এপ্রিল, ২০২০ ১৫:৪৭

২ মাস সময় পেলেও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ

এফ এম শাহীন

২ মাস সময় পেলেও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ

এফ এম শাহীন

প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল থাকা মানুষ নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিনাশ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। আমরা জানি, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া আছে। নিউটনের সেই তৃতীয় সূত্র ভুলে গিয়ে মানুষ নিজের অকল্যাণ নিজেই ডেকে আনে। এই যে নির্বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার সাজানো প্রকৃতির বিনাশ করছি, এতে চূড়ান্ত ভুক্তভোগী কে হচ্ছে? প্রকৃতি ও পরিবেশের রক্ষক হওয়ার বদলে আমরা যখন তার ভক্ষক হয়ে দাঁড়াই, তখন তার ফল কী ভয়াবহ হতে পারে, সে কথার আরেক উদাহরণ করোনাভাইরাস বললে ভুল হবে কি?

প্রকৃতি যদি সজীব হয়, যদি তার অনুভূতি থাকে, তাহলে তার এমন প্রতিশোধে অবাক হবার কিছু তো নেই। এখন প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘোষণা করেছে এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়! সকল জীব ও প্রাণের ন্যায্যতা চাই। মহান সৃষ্টিকর্তাও হয়তো মানুষের দম্ভ আর অত্যাচারের হিসেব চুকাতে বর্তমান মানুষের আহাজারি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন ।

এইদিকে জাপানের রাস্তায় যখন দেখি হরিণের দল দৌঁড়াচ্ছে, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে মানুষবিহীন নির্জনতায় খেলা করছে অজস্র ডলফিন আর সাগরলতারা ফুটে আছে সাগরের পাড়জুড়ে তখন ভাবি মানুষের অত্যাচারে কি ক্ষতিই না হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের! মানুষের দখলের ইতিহাস মনে পড়ে বারবার। আমরা কি পারবো প্রকৃতির সেই ক্ষত মিটিয়ে এই পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে পুনরায় ।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস করোনাভাইরাসকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ‘সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘপ্রধান সতর্ক করেছেন, করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে মহাসংকটে ফেলেছে।

জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির বরাতে আল–জাজিরা জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে ৮ লাখ ৫৭ হাজার মানুষের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৭৮ হাজার ব্যক্তি করোনামুক্ত হয়েছেন। করোনার আক্রান্ত হয়ে ৪২ হাজার মানুষ মারা গেছেন। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে উৎপত্তি হয় প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের।

তবে বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপে ছড়ানো করোনাভাইরাস নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা এবং তথ্য লুকানোর অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন দেশ এবং গণমাধ্যম। এদিকে ইচ্ছাকৃতভাবে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের মামলা করা হয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার এমপি জর্জ ক্রিস্টেনসেনও করোনাভাইরাসের জন্য চীনের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন।

যদিও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেডিকেল সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে চীন। যদিও নেদারল্যান্ড, স্পেনের মতো দেশ ওই সব সামগ্রীকে বিপজ্জনক উল্লেখ করে ফেরত দিয়েছে। আমাদের মত অনেক দেশ এই চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে অনেকাংশে ।

এখানে একটি তথ্য আমাদের অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে । মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে করোনাভাইরাসকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করার আগে থেকেই চীনে ফেস মাস্ক বিক্রি বেড়ে যায়। এছাড়া করোনার খবর বাইরের দেশে জানার আগ থেকেই বিশ্বে ফেস মাস্ক রফতানি বন্ধ করে দেয় চীন। পাশাপাশি বিদেশ থেকেও তখন প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ ফেস মাস্ক চীন আমদানি করে।

এদিকে বিগত দুই মাস সময় পেলেও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ । প্রেস ব্রিফিং এ করোনা মোকাবেলার সক্ষমতার কথা বারবার বলা হলেও অব্যবস্থাপনার চিত্র প্রথম থেকেই স্পষ্ট । সেই সাথে কয়েক মন্ত্রী-আমলার অবহেলা ও উদাসীনতা আজ দেশবাসীর কাছে পানির মত পরিষ্কার। সাধারণ জনতাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না ক্ষমতাধর কিছু মানুষ। তারই বহিঃপ্রকাশ দেখলাম আমরা করোনা নিয়ে আলাপ- আলোচনা আর ব্রিফিং-এ এই বিশ্ব মহামারীতে ।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে ছয়জনের মৃত্যু হলো। বুধবার ভিডিও কনফারেন্সে এ কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এই তথ্য দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

যদিও করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন উপসর্গের উপস্থিতির পরও সবাইকে টেস্টের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। যা সাধারণ মানুষের মনে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি করেছে। দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর পর তাদের বাড়ি লকডাউন করা হচ্ছে। যার ফলে স্থানীয় মানুষ আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। সাধারণের মনে প্রশ্ন আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে তাহলে কেন লাখ লাখ বেডের হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা আসছে ?

এইদিকে চার বছরের মধ্যে এই মৌসুমেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য তা–ই বলছে। শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন (এআরআই) বলতে সর্দি–কাশি, গলাব্যথা থেকে শুরু করে ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কুইলাইটাস ও নিউমোনিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে।

অব্যবস্থাপনার সাথে সাথে মোল্লা মৌলভীর কোরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা, মনগড়া মিথ্যা তথ্য ও গুজব রটিয়ে গনজমায়েত হতে সাধারণ মানুষকে উস্কানি দিয়েছে । কেউ বলছেন এই ভাইরাস মুসলমানদের আক্রমণ করে না, কেউ আবার ভাইরাসের সাথে স্বপ্নেও কথা বলছেন । এ সমস্ত ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে আরো কিছু গুজবের মধ্যে রয়েছে- থানকুনি পাতা খেলে, ঘন ঘন চা পান করলে, আদা অথবা রসুন দিয়ে গরম পানি খেলে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। “এ রোগ গরীবদের হয় না, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিশ্বাসীদের হয়ে থাকে।”

এইসব ধর্মান্ধ শক্তির কাছে নতজানু আমাদের নেতা-নেত্রীদের অসহায় চেহারাও আমরা দুঃখের সাথে প্রত্যক্ষ করছি । মক্কা-মদিনায় নামাজ আদায় বন্ধ করতে পারলেও আমরা জুমা’বার বা মসজিদে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য দেখিনি । সকল এয়ারপোর্ট বন্ধ হলেও কোন শক্তির উপর ভর দিয়ে আমরা আমাদের এয়ারপোর্ট খোলা রেখেছি সেই জবাব কেউ চাইছি না । আবার হোম কোয়েরেন্টাইন এর নামে প্রবাসী ভাইয়েরাও সর্বোচ্চ উদাসীনতা দেখিয়ে সকল নির্দেশনা অমান্য করে নবাবজাদার মত ঘুরে বেড়িয়েছেন ! পুরো জাতিকে ফেলেছেন ঝুঁকিতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বীকৃত ওষুধ ও প্রতিষেধক এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। তাই রোগ শনাক্তকরণে পরীক্ষা জোরদার করতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার পাশাপাশি পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ ফুট বা ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম এড়ানো, গণপরিবহন ব্যবহার না করার মতো বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।

নেদারল্যান্ডসের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ের প্রকাশিত সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক সাময়িকীতে গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধেও করোনা ঠেকাতে সামাজিক দূরত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, চীনের সাংহাইটেক ইউনিভার্সিটি ও হংকংয়ের চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের একদল গবেষক। এতে বলা হয়, উহান শহর অবরুদ্ধ করা না হলে শুধু চীনেই আরও ৬৫ শতাংশ মানুষ করোনা সংক্রমিত হতো।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই আপাতত সমাধান। আগামী ১৫ দিনের জন্য আমাদের ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে । মানুষের নিরাপত্তার জন্য বন্ধ করতে হবে সবরকমের গণজমায়েত । তাই দ্রুত মানবকল্যাণে হেলাফেলা না করে স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ মতো ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। অতি জরুরী না হলে যত কষ্টই হোক না কেন নিজের জন্য, নিজের পরিবার তথা রাষ্ট্রের জন্য ঘরে থাকতে হবে।

আমরা জানি জরুরী অবস্থা কিংবা সাধারণ ছুটি করোনামুক্ত করবে না কিন্তু এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাবে পুরো জাতিকে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে আহবান, অন্য কোন বাহিনী দিয়ে এই ভাইরাস সংক্রমণ কমানো গেলেও মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। দ্রুত চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত সকলের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে করোনার সাথে যুদ্ধ করতে হবে।

এই মহামারী আর আতঙ্কের মধ্যে বিশ্বাস করতে চাই, সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত ও সম্মিলিত কার্যক্রমের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ, ঘুরে দাঁড়াবে বিশ্ব । প্রকৃতির সাথে মানবিক আচরণে করোনার সাথে মানুষের এই যুদ্ধ থামবে। পৃথিবী তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। মানুষের জয় হবেই।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম।
সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১’।
মেইল- fmshahin71gmail.com

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

সর্বশেষ খবর