২২ জুন, ২০২০ ২১:১৯

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পেয়েছি

ড. কাজী এরতেজা হাসান

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পেয়েছি

ড. কাজী এরতেজা হাসান

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই মুসলিম লীগ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ষড়যন্ত্রের ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের ‘অপশাসন’-এর বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রামের সূচনা করে। এ কারণে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দলটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। একই সময়ে  ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সার্থক সংগ্রামের সূচনা হয়। কৃষক প্রধান পূর্ববঙ্গে বা বাংলাদেশেই অধিকাংশ কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের সময় কৃষক বিদ্রোহের অগ্নিশিখা কখনই নিভে যায়নি। বিশ শতকে পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহী কৃষক  জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আশায় পাকিস্তান নামক একটি ‘কল্পরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সামিল হয়েছিল। কিন্তু ‘কল্পরাজ্য’-এর খলনায়করা যখন ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন জিঞ্জির পরিয়ে দিতে উদ্ধত হয়, মুখের ভাষা কেড়ে নিতে বাঙালি ছাত্রদের বুকে গুলি চালায়, তখনই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সার্থক সংগ্রামের সূচনা হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৯৫০ দশকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, পূর্ববাংলার ন্যায্য হিস্যা নিয়ে জনগণকে সংঘটিত করে । ১৯৬০ দশকে আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাংলাদেশকে নিয়ে যায় স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বারে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল, সময়ের স্রোত পেরিয়ে সেই দল এখন ৬৯ বছরের পুরনো দলই বটে। যদিও সেই দলের হাতেই আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব। সেই দল যখন সরকার পরিচালনা করছে , তখনই মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পৌঁছেছে। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের এবং উন্নত দেশ গড়ার সংগ্রামের কথা আমরা অহরহ শুনছি আওয়ামী লীগ নেতাদের কণ্ঠে। মঙ্গলবার একাত্তরে পা দিবে আওয়ামী লীগ। একটানা ১২ বছর ধরে দেশের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী নেতারা। 

দেশ স্বাধীন করার কৃতিত্ব নিয়েই স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও ভেবেছিলেন সাধারণ মানুষের মন জয় করার কথা। উদ্ধৃত করতে চাই ১৯৭২ সালে ৯ এপ্রিল ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে দেয়া জাতির জনকের ভাষণ। তিনি বলেছিলেন, ‘বিরোধীদলে থাকা এক রকমের আর সরকারের পক্ষে রাজনীতি করার জন্য পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজের দিকে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে। অত্যাচার-অবিচার যেন না হয় । জুলুম যেন না হয়। লুটতরাজ যেন না হয়। দেশের মানুষকে সেবা করে মন জয় করতে হবে।’

১৯৪৯ সালে দল গঠন,দলের নাম পরিবর্তন করে অসাম্প্রদায়িক দল করা এবং দেশ স্বাধীনের কৃতিত্ব থাকা সত্যেও জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে । ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ১৫ বছর সংগ্রাম করে দলের প্রতিষ্ঠা দিবসেই প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুনের পর দেশে প্রথমবারের মত সরকারের মেয়াদ পূরণ শেষে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম নজিরও স্থাপন করেছিলেন তিনিই।কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর তাকেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল দলের মধ্যেই। সব কিছু অতিক্রম করেই শেখ হাসিনা এখন সবচেয়ে বেশি সময়ের সরকার প্রধান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার পদ্মাসেতু করছেন , ঢাকার অসহনীয় যানজটে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসীর সামনে মেট্রো রেল উকি দিচ্ছে, পারমানবিক বিদ্যুতের দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ , উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে দেশ , কিন্তু আপনি এলাকায় কি সুনাম কুড়িয়েছেন ? আপনার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কি চাঁদাবাজিতে ওস্তাদ ? আপনার নেতারা কি টেন্ডার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ? তারা কি সংখ্যালঘু-দুর্বলদের কাছে ত্রাস হিসেবে চিন্তিত? প্রশ্ন আরও অনেক কিছুই উঠবে আগামী ভোটের আগে।তাই আগামী ২৩ জুন শপথ নিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা । বারবার পাঠ করুন জাতির জনকের দেয়া নানা ভাষণ । ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লার সামরিক একাডেমিতে শেখ মুজিব দৃপ্তকণ্ঠেই বলেছিলেন, ‘যদি আমরা সোনার ছেলে তৈরি করতে পারি, তাহলে ইনশাল্লাহ আমার স্বপ্নের সোনারবাংলা একদিন অবশ্যই হবে। আমি হয়তো দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু তা হবে। আজ বাংলাদেশের সম্পদ কেউ লুট করে নিতে পারবে না । বাংলার মাটিতেই তা থাকবে, তিনি বলেছিলেন ” আমি প্রতিজ্ঞা করেছি বাংলাদেশের মাটি থেকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর আর চোরাচালানকারীদের নির্মূল করবো ।’ একই বছর ১৫ জানুয়ারি ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকবো।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের সময় বারবারই বলছি জাতির জনকের নানা ভাষণের কথা। কারণ কখনও কখনও মনে হয় উন্নয়ন করে, ডিজিটাল বাংলার শ্লোগান দিয়ে একটানা ১২ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কি অল্প হলেও ‘আত্ম অহংকারী ” হয়ে উঠছে ? দলীয় প্রধান রাতদিন পরিশ্রম করছেন, অর্থনৈতিক সূচক-পরিসংখ্যান বলছে রাষ্ট্র হিসেবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে,তাহলে কেন সমালোচনাও শুনতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে? কেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নামে এত অভিযোগ ? কেন কথায় কথায় বলা হয় ” সব ঠিক আছে কিন্তু সুশাসনের অভাবে ম্লান হচ্ছে শেখ হাসিনার সাফল্য ?  

১৯৪৭ সালের বিভাগ-পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ নেতারা ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাদের নেতৃত্বেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বাংলার বিধানসভার হিন্দু সদস্যগণ দেশ-বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রদেশ বিভাগের পক্ষে রায় প্রদান করেন (পক্ষে ৫৮, বিপক্ষে ২১)। এর পর পরই মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার আইনসভার জন্য নেতা নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। ৫ অগাস্ট অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দীন ৭৫-৩১ ভোটে সোহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। খাজা নাজিমউদ্দীন ও নূরুল আমীন নেতৃত্বাধীন বাংলার মুসলিম লীগের অংশটি ছিল গণবিচ্ছিন্ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি রাজনীতির বলয়ভুক্ত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ও পরে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল অংশটিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। বলা বাহুল্য যে, এ সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পাকিস্তান আন্দোলনে এদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশ বিভাগের পর এ সকল নেতা-কর্মী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নতুন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ে ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে অবস্থিত ছিল মুসলিম লীগের ওয়ার্কশপ ক্যাম্প। ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাম্পের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন শামসুল হক (টাঙ্গাইল)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ক্যাম্পটিকে ঘিরে প্রতিবাদী মুসলিম লীগ কর্মীরা সংগঠিত হন। মাওলানা আকরম খাঁ তখন পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সভাপতি। ১৯৪৯ সালের মে মাসের দিকে বাংলার মুসলিম লীগের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা এক সম্মেলন অনুষ্ঠান করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। এই প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কাছে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ব্যাপারে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি পূর্ব বাংলার আকরম খাঁ, নাজিমউদ্দীন প্রমুখকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন। এতে পূর্ব বাংলার প্রতিবাদী ও তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীরা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন।

এই সময়ের আরেকটি ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম ও পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ শাখাকে একীভূত করে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। এতে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী এবং সদস্য দেওয়ান বাসেত ও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যভুক্ত হন। মাওলানা আকরম খাঁ এই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই একটি নতুন কমিটি গঠন করেন। এছাড়াও পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ববঙ্গ বিরোধী কার্যকলাপ, ভাষা-সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ, সাধারণ জনজীবনের বিপর্যয় ইত্যাদি ঘটনাবলি মুসলিম লীগের তরুণ অংশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। দেশ পরিচালনায় মুসলিম লীগের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দমননীতি শিক্ষিত সুধী সমাজকে দারুণভাবে হতাশ করে। এভাবে পূর্ববাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে দেয়।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এই সম্মেলনে প্রায় তিনশ প্রতিনিধি অংশ নেন। এতে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ কে ফজলুল হকও সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি তখন পূর্ব বাংলা সরকারের এডভোকেট জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত। সম্মেলনে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি যথাক্রমে আতাউর রহমান খান (অ্যাডভোকেট), সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমদ (এমএলএ), আলী আমজাদ খান (অ্যাডভোকেট), আবদুস সালাম খান (অ্যাডভোকেট), সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহ-সম্পাদক মোশতাক আহমদ, এ কে এম রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান।

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে এই দলের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমশ পূর্ব বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত জননেতায় পরিণত হন এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দান করেন। তার রাজনৈতিক উত্থান মূলত শুরু হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের সূচনা থেকে।

শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান চল্লিশের দশকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই তিনি কয়েকবার কারারুদ্ধ হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থন করার অভিযোগে ও বিভিন্ন হল ছাত্রনেতাদেরকে বহিষ্কার ও জরিমানা করার প্রতিবাদে গ্রেপ্তার হন। কোনো জরিমানা ও সরকারের কাছে মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় ১৯৪৯ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। অতএব আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে ১৯৪৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়কালে তিনি বিরোধী রাজনীতির ধরনটা আয়ত্ত করেন এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকে তৈরি করেন। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মনে প্রাণে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাই ঢাকায় ফিরে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধেই তরুণদের সংগঠিত করেন। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ গঠনে ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠন ও মন্ত্রী হিসেবেও যতটুকু সম্ভব অবদান রেখেছিলেন।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাংগঠনিক দক্ষতায়, আন্দোলন-সংগ্রামে, এই অঞ্চলের জীবন-বাস্তবতার আলোকে রাজনীতি পরিচালনায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার বিকাশে, সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তব রূপায়ণে এই দল একক ও অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার। এই দলের প্রথম ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয় যে, দেশ বিভাগের পর মুসলিম লীগ দেশ পরিচালানায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনে যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা অপরিসীম, দেশ বিভাগের পর তারা নেতৃত্বে আসতে পারেনি। মুসলিম লীগ জনগণের সমস্যা সমাধানে কোনো প্রকার উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। শাসক দল বিভিন্ন ধরনের কালাকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অবদমিত করে রাখে। মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গি দেশে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত এবং ভারত থেকে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসিত করার ক্ষেত্রে সরকার কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষত পূর্ব বাংলায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণ, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের সঠিক প্রতিফলনকল্পে একটি রাজনৈতিক দলের বাস্তব ও সময়োপযোগী প্রয়োজন থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।

দলের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি থাকায় পরবর্তীতে কেউ কেউ আপত্তি করছিলেন। এ নিয়ে দলে বেশ একটি বিরোধ তৈরি হয়েছিল, যে মুসলিম শব্দটি থাকবে নাকি থাকবে না। তখন হিন্দু এবং মুসলিম আসনে আলাদাভাবে নির্বাচন হতো। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, এই দলটি একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে। ওই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায় যুক্তফ্রন্ট, যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফত পার্টি আর নেজামে ইসলামী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।

যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। 'যদিও মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য জোর দিচ্ছিলেন, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুন। কারণ তার ভয় ছিল, এটা বাদ হলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগে যে কাউন্সিল হয়, সেখানে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ফলে অমুসলিমরাও এই দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পান। তবে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ দুইটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে প্রবাসী সরকারের সব কাগজপত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার হতে শুরু করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিল, সন্দেহ নেই। এ বছরটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ হিসেবে পালিত হচ্ছে। আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। আওয়ামী লীগ উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য সামনে রেখেছে। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। করোনার ভয়ঙ্কর থাবা এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার পথে কতটা বিঘ্ন সৃষ্টি করবে? নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। কোনো স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ এভাবে বিশ্বব্যাংক বা পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সক্রিয় নেতা-কর্মীরা নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা সফল হবে, সেটাই দেখার বিষয়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা ও দ্যা পিপলস টাইমস, পরিচালক, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প বাণিজ্য ও ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য।

সর্বশেষ খবর