১৮ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৩৯

বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’

সোহেল সানি

বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’

সোহেল সানি

দোষে-গুণেই মানুষ। কিন্তু এমন এক একটি গুণ থাকে, যার জন্য শতদোষও খন্ডিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যেও তার তীব্র স্বকীয়তা ও পরনির্ভরহীনতা সবাইকে আকৃষ্ট করতো। বঙ্গবন্ধুর ছিলো অমোঘ আকর্ষণীয় শক্তি-যা বারবার কাছে টানতো। আমরা ছিলাম অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধ। সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন উপরোক্ত কথা গুলো লিখেছেন তার একটি গ্রন্থে। 

তিনি লিখেছেন, পারসনাল ক্যারিশমা যাকে বলে, তা ছিলো তুলনাহীন। আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত। সবসময় ভাবতাম তার স্নেহ আছে, আর আমাকে পায় কে? রাজনীতিতে যোগ্যতাই কাজ করে তা নয়, দরকার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।
তার সান্নিধ্য ভালো লাগতো।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম জাতীয় পার্টির মহাসচিব ছিলেন। ষাটের দশকের শুরুতেই ছাত্রলীগের সভাপতি। প্রথম চিফ হুইপ। আলোচিত সমালোচিতও এ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।  

শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, ৬২ সালের দিকেই শেখ মুজিবুর রহমান নিজহাতে মুসাবিদা করে নিজে প্যাডেল চালিয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার সপক্ষে লিফলেট ছেপে আনতেন। গভীর রাতে সাইকেলে চড়ে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমি তা বিলি করতাম। 

অনেক নেতার ভিড়ে একটি সাহসী কন্ঠস্বর তার (বঙ্গবন্ধু)। আপসহীন মনোভাব, দেশপ্রেম ও মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে ত্যাগ-তিতিক্ষার পথে যখন যাত্রা শুরু করলেন, তখন বিধাতাও তার হাত উজাড় করে বরমাল্য দিলেন। শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের নেতা, একটি দলের নেতা। সেখানে অচিরেই জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত হলেন। ৬ দফার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিলো। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন। তারপর তার স্বপ্নের বাংলাদেশ। 

শাহ মোয়াজ্জেম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকাশ করে লিখেছেন, তার (বঙ্গবন্ধুর) নেতৃত্বে চিরদিন আস্থাশীল ছিলাম। জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ দুঃখজনক। আওয়ামী লীগ না করাই আমার অপরাধ। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রীর যোগদানের পর না বলার কারণ ছিলো না। এ ছাড়া কিছুটা ভয়ভীতি তো ছিলোই। চিফ হুইপ থেকে মন্ত্রী করার কথা বলা হলেও প্রতিমন্ত্রী করা হয়। প্রথম জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, পদটি প্রতিমন্ত্রীর সমমর্যাদা সম্পন্ন ছিলো।

আকারে-ইঙ্গিতে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা আকাঙ্খা করেছি। এ আকাঙ্খা পূরণ না হলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি ছিলাম অবিচল। স্বাধীনতার তেজ ছিলো বঙ্গবন্ধুর মজ্জাগত। ভারতের বিষয়ে বলতেন, হ্যাঁ প্রয়োজনে ওদের সাহায্য নিয়েছি। সে জন্য সর্বদা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবো। কিন্তু তাই বলে আমরা কারো মাখা তামাক খাইনা। কেউ অহেতুক অভিভাবক হয়ে দাঁড়াবে এটা বঙ্গবন্ধুর কাছে বাঞ্ছনীয় ছিলো না। হাইকমিশনার হয়ে ডিপি ধর আসলেন। মি. ধরের প্রস্তাবগুলো তার মনঃপুত হয়নি। দেশ শাসনে বঙ্গবন্ধুর মস্তিষ্কের চাইতে হৃদয়ের প্রভাবই কাজ করেছে অধিকতর। কিন্তু একটি বিষয়ে মতান্তর ছিলো না যে বঙ্গবন্ধু একজন সত্যিকারের স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন এবং যতবড় বন্ধুই হোক ভিনদেশের অছিগিরি তার অত্যন্ত অপছন্দনীয় ছিলো। 

ইন্দিরা গান্ধী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন কাঠামো গঠনে সহায়তা করার জন্যই ডিপি ধরকে হাইকমিশনার করে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মি. ধর এক রাতে সমভিব্যাহারে গেলেন। সৌজন্যমূলক কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করেই বলে বসলেন, মি. ধর, কবে দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন? এসেছেন মাত্র, কয়েকটা দিন আমাদের এখানে কাটান। বাংলাদেশ মাছের দেশ। এখানকার পদ্মার ইলিশ খুবই উপাদেয় ও মজাদার। কয়েকদিন মাছ-টাছ খান, তারপর যাবেন। 

ডিপি ধর হতবাক, প্রথম দিবসেই তাকে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয়া হলো, কিন্তু কেনো? ওদিনই তিনি বার্তা পাঠান দিল্লিতে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যা বুঝার বুঝেছেন। ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দিলেন মি. ধরকে। প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরীর বরাত দিয়ে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তার গ্রন্থে এ কথা লিখেছেন। 

তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এভাবে সরাসরি ডিপি ধরকে অপ্রস্তুত করে ফেলে দিল্লিতে ফেরানোর পথনির্দেশ দিতে পারতেন না। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য এবং গৌরবোজ্জ্বল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বাংলাদেশ কখনও কার্পণ্য করেনা। কিন্তু সেই সুবাদে নানা অবিমৃষ্যকারীতা নীরবে সহ্য করে যেতে হবে এটাও একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির কাম্য হয় কি করে? ভারতীয় বাহিনীকে স্বদেশে ফেরানো কোনো সহজ ব্যাপার ছিলো না। বাস্তবতার সঙ্গে একটা চক্ষুলজ্জা বলেও তো কথা। সরকারের ও আওয়ামী লীগ নেতারা বিচলিত কীভাবে সেনাবাহিনী ফেরাবেন তা বোধগম্য হচ্ছিল না কারোরই। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু সরাসরি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তাগিদ দিয়ে বসলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ফেরত নিতে হবে। ইন্দিরা গান্ধী বললেন, আপনার আগামী জন্মদিনের আগেই ফিরিয়ে আনা হবে। ঠিকই সম্মানের সঙ্গে তারা তাদের মাটিতে চলে গেলো। দেশের মানুষ স্বস্তি পেলো। 

শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ মুসলিম দেশসমূহের ইসলামি সম্মেলন। গণভবনে বৈঠক বসলো। বঙ্গবন্ধুর যোগদান প্রশ্নে একটি অংশ ‘না’ যাবার পক্ষে মত দিলো। 'না' এর পক্ষে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান ঠিক হবে না। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান তাই যাবার পক্ষে মত দিলেন কেউ কেউ। বঙ্গবন্ধু যখন যাবার পক্ষে মত দিচ্ছিলেন, তখন যারা না বলছিলেন, তারা প্রস্তাব দিলেন, ঠিক আছে যেতে চান যান, কিন্তু যাত্রাপথে দিল্লিতে নেমে ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে গেলে সবদিক রক্ষা হয়।

বঙ্গবন্ধু টেবিল চাপড়িয়ে রীতিমতো ক্রুদ্ধ কন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, আমি কারো মাখা তামাক খাই না যে, আমাকে মাঝপথে নেমে কারো মত নিতে হবে। তোমরা ভেবেছো কী? আমাদের সার্বভৌম দেশ। কী করবো না করবো আমরা  সাব্যস্ত করবো। কাউকে ট্যাক্স দিয়ে চলার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি।

সোহেল সানি: সিনিয়র সাংবাদিক

বিডি প্রতিদিন/আল আমীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর