২৯ নভেম্বর, ২০২০ ২৩:৫৪

লোহিত সাগরের তীর থেকে জিবুতির চিঠি

নাজমুন নাহার

লোহিত সাগরের তীর থেকে জিবুতির চিঠি

নাজমুন নাহার

আমার মাথার উপর কাঠফাটা রোদ। আমি জিবুতির আর্থা পর্বত থেকে সামনে লোহিত সাগরের দিকে তাকিয়ে আছি। অবশেষে আমি জিবুতির জীবনে অভিযান করছি।

প্রচণ্ড গরমে প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। জিবুতি শহরের তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি এটাই নাকি তাদের শীতকাল। একদিকে লোহিত সাগরের নীল পানি আর অন্যদিকে কালো কালো ভলকানিক পাথুরে পাহাড়ের অভিযান আমাকে তামাটে করে তুলেছে গত এক সপ্তাহে। এর মাঝে পরবর্তী দেশে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। সোমালিল্যান্ডের ভিসা ও সুদানের ভিসা এই দেশ থেকেই নিলাম। ভ্রমণ কতটা চ্যালেঞ্জিং এই মুহূর্তে আমি তা টের পেলাম গত কয়েকদিনে। যেহেতু সব চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করবো বলে পথে নেমেছি তাই পথ আমাকে এই মুহূর্তে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি এখন জিবুতি থেকে সোমালিল্যান্ডের পথে অভিযাত্রা শুরু করলাম সড়কপথে। দুস্তর মরু প্রান্তর ভেদ করেই ১৪২তম দেশে অভিযান চলছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহের অভিযাত্রা আমাকে অনেক চমক দিয়েছে জিবুতি, বালবালা ও আর্থা শহরে।  

আমার জিবুতিয়ান বন্ধু সাহারা, হিবো, হোসাইন আমরা আর্থা পর্বত টাউনে একসাথে অ্যাডভেঞ্চার করেছি। আমি যখন আর্থা পর্বতের টাউনে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা যখনই উঁচু করে ধরলাম হিবো আমার ছবি তুলছে সামনে থেকে। হঠাৎ একটা আমেরিকান জিপ আমাদের পাশে এসে ঘেঁসে দাঁড়াল। আমি চমকে যেয়ে এক পাশে সরে পড়লাম। এক সাদা ভদ্রমহিলা ড্রাইভিং সিট থেকে হাসতে হাসতে মুখটা বের করে দিয়ে আমাকে বলল-তোমাকে আজ 'লা নেশন' পত্রিকায় দেখেছি, গাড়ির ভেতর থেকে তার পেছনের সিটে বসা মেয়ে অলিভিয়া পত্রিকাটি গাড়ির জানালা দিয়ে বের করে দিয়ে বলছে এটা কি তুমি? আমি হাসতে হাসতে বললাম হাঁ আমি। 

একই ঘটনা ঘটেছে জিবুতি পার্লামেন্টের সামনে যখন আমি দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা হাতে। জিবুতির ঘরে ঘরে এখন পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা খচিত ছবিসহ আমার জিবুতিতে পদার্পণের স্টোরি। আমি আসার পরের দিনই লা নেশন পত্রিকার কেনেডি ইব্রাহিম ও আর্থ আমার ইন্টারভিউ করলো। তাদের জাতীয় পত্রিকার পেছনের পাতার পুরো অংশ জুড়ে খবর হলো। আমাকে জিবুতি এডুকেশন মিনিস্ট্রি থেকে জানানো হলো অভিনন্দন। 

তাপমাত্রা খুব প্রখর গরম হলেও জিবুতি আমাকে অনেক আনন্দ দিচ্ছে। এখানকার মানুষ খুবই সহায়তা পূর্ণ। আতিথেয়তা, বিনয় এবং সারল্য তাদেরকে আরও মাধুর্যপূর্ণ করেছে। বিশেষ করে এখানকার মজাদার খাবার সত্যিই আমার জিভে এখনো লেগে আছে। সাম্বোসা আফ্রিকার হর্ন জিবুতির জনপ্রিয় খাদ্য। মাংস বা মটর, মসুর বা আলু ভাজা ভর্তি করে ময়দা ভাঁজ করা হয়, তারপরে সেদ্ধ বা ভাজা হয়। সন্ধ্যার নিয়ন আলো আর জিবুতি সিটির ডাউনটাউন স্ট্রিটে জিবুতিয়ান বন্ধুদের সাথে এই সাম্বোসা খাবারের স্বাদ মনে থাকবে। 

জিবুতিতে, এই সুস্বাদু প্যাস্ট্রি মাংস এবং পেঁয়াজ ভর্তি দিয়ে তৈরি করা হয়, ত্রিভুজাকার পেস্ট্রিতে ভাঁজ করা হয়, তারপর সোনালি বাদামী এবং খসখসে অবধি গভীর ভাজা হয়। এটি কিছু আফ্রিকান গরম সস দিয়ে পরিবেশন করা যেতে পারে। হরিরা, নিতের কিব্বে ও এখানকার জনপ্রিয় খাবার। তবে জিবুতি খুবই বায়বহুল দেশ। 

আফ্রিকার হর্নে অবস্থিত, জিবুতি প্রকৃতি এবং ইতিহাস প্রেমীদের, খাদ্য উৎসাহীদের জন্য এবং নিওলিথিক যুগের পরে থেকে বসবাসকারী এই ক্ষুদ্র ভূমি নৃতাত্ত্বিক স্বর্গের একটি ছোট টুকরো। এই আকর্ষণীয় দেশটি আমাকে নানাভাবে মুগ্ধ করেছে। জিবুতিতে তিনটি নৃগোষ্ঠী সোমালি, আফার এবং আরবরা শান্তিতে পাশাপাশি বাস করছে। জিবুতিয়ান লোকেরা বিদেশিদের খুব পছন্দ করে এবং আতিথেয়তা পূর্ণ। আপনি জিবুতিদের সাথে কখনই একাকীত্ব বোধ করবেন না। তারা প্রচুর গল্প করতে জানে। 

স্নোকার্কেলিং, তিমি এবং হাঙ্গর দিয়ে ডাইভিংয়ে যাওয়া, লোহিত সাগরের মুক্তো মোচা দ্বীপে ডলফিনের সাথে সাঁতার কাটা দেখা যেন এক আশ্চর্যজনক অধ্যায় যুক্ত হল আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। এখানে আমি বিভিন্ন ধরণের অসাধারণ কিছু ল্যান্ডস্কেপ দেখেছি। যেমন আগ্নেয়গিরি, ডুবে যাওয়া সমভূমি, উপরে থেকে বাষ্পযুক্ত চুনাপাথরের চিমনি, লবণের হ্রদ, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এবং টকটকে মালভূমি। এখানে আফ্রিকার একমাত্র আমেরিকান ফরাসী, জাপানি, জার্মান সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। জিবুতি শপিংমলে যখন আমি গিয়েছিলাম তখন সেখানে বেশিরভাগই আর্মিদের মলের ভেতরে কেনাকাটা করতে দেখেছি। তবে এই দেশটির একদিকে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গেট হিসেবে ভৌগলিক অবস্থান বুঝা যায়। উত্তর পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির অবস্থান থেকে তাকালে দেখা যায় এর বামদিকে এরিত্রিয়া ডানদিকে সোমালিল্যান্ড এবং পেছনের দিকে পড়েছে ইথিওপিয়া। 

লোহিত সাগরের ঠিক অপর পাড়ে রয়েছে ইয়েমেন, তার বামে সৌদি আরবের মক্কা-মদিনার অবস্থান দেখা যায়। কি অপূর্ব আমি ঠিক এই অবস্থানে এখন লোহিত লোহিত সাগরের পাড় ঘেঁষে গেছে অভিযাত্রা করছি। করোনার সময় ট্রাভেল যেমনি কঠিন তেমনি ব্যয়বহুল। তারপরও কষ্টকে দূরীভূত করলাম মানসিক শক্তি দিয়ে। এখানে এখন করোনা শূন্য বলা যায়। জিবুতি এয়ারপোর্টে নামার সাথে সাথে সেদিন সকল যাত্রীকে অন এরাইভাল এয়ারপোর্ট করোনা ল্যাবরেটরিতে করোনা পরীক্ষা করতে হলো। তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর হাতে নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে বের হতে হলো জিবুতিতে। অনেক অপেক্ষা করতে হলেও সিস্টেমটা ভালো লেগেছে। সোমালিল্যান্ডের উদ্দেশে আমাকে আবারো করোনা টেস্ট করতে হলো। আল্লাহর রহমতে আমি এখন পর্যন্ত সুস্থ এবং করোনা নেগেটিভ নিয়ে অভিযাত্রা করছি। বাকি পথটুকুর অভিযাত্রা এখন শুধু স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথ চলা। ইচ্ছের আকাশে যদিও অনেকগুলো দেশে অভিযাত্রা করার অভিপ্রায় নিয়ে চলছি তবুও বলবো বিধাতা আমাকে যেখানে নিয়ে যায় আমি তার জমিনে সায়ের করার জন্য সেখানেই যেতে থাকবো। এই কঠিনকে ভালবেসে আমি লাল-সবুজের পতাকাকে উঁচু করে ধরবো এভাবেই পৃথিবীর পথে পথে। লোহিত সাগর থেকে এই পতাকা উড়াতে উড়াতে আরব সাগরের পাড়ে আমি গেঁথে দেবো একটি বাংলাদেশের নাম। 

লেখক: বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী, ১৪২ দেশ ভ্রমণকারী।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর