জীবদ্দশায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের তীব্র সমালোচক ছিলেন অনেকেই। কর্তৃত্ববাদী হিসেবে তাকে ভাবতেন ফিলিস্তিনিদের কেউ কেউ। কারও কারও মতে তিনি ছিলেন আপসকামী। লড়াকু সংগঠন হামাসের অনেক সদস্য ইয়াসির আরাফাতের ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবে ছিলেন রুষ্ট। তবে ফিলিস্তিনি নেতার বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে তারা নীরব থাকতে বাধ্য হতেন। সেই সমালোচকরাও পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন নেতা হিসেবে আরাফাতের জুড়ি নেই। কঠিন অবস্থার মোকাবিলা কিভাবে করতে হয় এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অসামান্য প্রজ্ঞার অধিকারী। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে সুবিধা আদায়ের কতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। নেতৃত্বের জন্য যে কারিশমা থাকা প্রয়োজন আরাফাত ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হজরত ঈসা (আ.) বা যিশু খ্রিস্ট। তাকে বলা হতো জনগণের রাজা। প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জানা কথা যিশুর কোন রাজ্য ছিল না। কিন্তু জনগণের হৃদয় রাজ্যের অধিপতি ছিলেন তিনি। আরাফাত ছিলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের কাছে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো আরাফাত যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, গত কয়েক শতাব্দীতে তা কখনও স্বাধীন দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। সেই ১৯৪৬ সাল থেকে এ দেশটি ইসরায়েলিদের নাগাপাশে আবদ্ধ। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির পর আরাফাত দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। সীমিত আকারের স্বায়ত্তশাসন পায় ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু সে স্বায়ত্তশাসনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ইয়াসির আরাফাত নিজেই মৃত্যুর আগের তিন বছর অবরুদ্ধ জীবনযাপন করেছেন। তাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি নেতার সদর দফতরে ট্যাংকের গোলা ছুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
আরাফাত ছিলেন দুনিয়ার একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান- যিনি কখনও সামরিক পোশাক ত্যাগ করেননি। এমনকি প্রায় সর্বক্ষণ অস্ত্রবহনও করতেন তিনি। মাথায় আরবিয় স্কার্ফ, জলপাই রংয়ের ইউনিফরম এবং কোমরে রিভলবার, আরাফাতের অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হতো। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় আরাফাত তার অস্ত্র নিয়ে বিড়ম্বনার মুখে পড়েন। বিষয়টি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার সুবিখ্যাত আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেছেন। মাই লাইফ’ নামের ওই বইয়ের ৫৪২ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে বেশ মজাদার তথ্য রয়েছে।
স্মর্তব্য যে, ক্লিনটনের সময় হোয়াইট হাউসে আরাফাতের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আরাফাত শান্তিচুক্তির সময়ও কাছে অস্ত্র রাখতে চেয়েছিলেন। আপত্তি করেন ক্লিনটন। তিনি তাকে বোঝাতে সক্ষম হন- শান্তি চুক্তির সময় আরাফাত হোয়াইট হাউসে অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এলে তা একটি ভুল ম্যাসেজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি আশ্বাস দেন, অস্ত্র ছাড়াই ফিলিস্তিনি নেতা হোয়াইট হাউসে নিরাপদ থাকবেন।
ইয়াসির আরাফাতের অস্ত্র সঙ্গে রাখা নিয়ে একবার বেশ বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। শ্রীলংকা সফরে গিয়েছিলেন আরাফাত। তার সম্মানে সে দেশের প্রেসিডেন্ট মিস কুমারাতুঙ্গা এক ভোজসভার আয়োজন করেন। সে ভোজসভায় প্রেসিডেন্ট কুমারাতুঙ্গা রসিকতা করে আরাফাতকে বলেন, আশা করি, মি. প্রেসিডেন্ট এখন আর অস্ত্র সঙ্গে রাখেন না? এ রসিকতার জবাবে মৃদু হেসে আরাফাত তার পকেট থেকে রিভলবার বের করে টেবিলে রাখেন। যা দেখে চমকে ওঠেন উপস্থিত অনেকে। কারণ রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় কারোর অস্ত্র বহন অনুমোদনযোগ্য নয়। কিন্তু দুই প্রেসিডেন্ট এটিকে ‘জোক’ হিসেবেই নেন। তাতে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। ভোজসভায় উপস্থিত এক তামিল এমপি বিষয়টি ফাঁস করে দেন। বাধ্য হয়েই কুমারাতুঙ্গাকে সাফাই গাইতে হয়। তিনি জানান, ভোজসভায় আরাফাতের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের দেওয়া রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় ইয়াসির আরাফাত অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলেন কিনা। এ অস্বীকৃতির পর বিতর্কের সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো, আরাফাত রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা ভোগ করা সত্ত্বেও সর্বক্ষণ অস্ত্র কাছে রাখতেন কেন? এ প্রশ্নটি নিয়ে একবার কথা হয়েছিল এক ফিলিস্তিনি বন্ধুর সঙ্গে। যিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার মতে, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধান হিসেবে স্বীকৃত হলেও আরাফাত সব সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলেই ভেবেছেন। স্বাধীনতা পাওয়ার আগে ফিলিস্তিনিদের যোদ্ধাবেশ ত্যাগের যে কোন অবকাশই নেই সামরিক পোশাক আর অস্ত্রবহন করে আরাফাত সে ম্যাসেজই দিয়েছেন।
ইয়াসির আরাফাত ছিলেন ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতি ওয়াদাবদ্ধ একটি নাম। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হতেন তিনি। ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও সব পক্ষের কাছেই তিনি ছিলেন গ্রহণযোগ্য। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা নিজেদের জীবনের চেয়েও আরাফাতের নিরাপত্তাকে সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। যে কারণে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসেদের দক্ষতার ঈর্ষণীয় সুনাম থাকলেও তারা কখনও আরাফাতের টিকিটি ছুঁতেও পারেনি। আরাফাতের প্রতি সহকর্মীদের ভালবাসা ও দায়িত্ববোধের প্রমাণ মেলে একটি ঘটনায়। ঘটনাটি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তিচুক্তিরও বেশ আগের। ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল। এয়ার বিসাউ-এর বিমানে করে তিউনিস থেকে লিবিয়া যাওয়ার পথে ফিলিস্তিনি নেতাকে বহনকারী বিমানটি মরুঝড়ের কবলে পড়ে। পাইলট ও ক্রুরা নিশ্চিত হয়- তাদের বিমানটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আরাফাতের সফরসঙ্গীদের মুখে তখন চরম উৎকণ্ঠা। নিজের জীবন নয়, নেতার জীবন কিভাবে রক্ষা করা যায়- সে বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন। সৌভাগ্যক্রমে বিমানটিতে ছিল বেশকিছু কম্বল। নিরাপত্তারক্ষী ও সফরসঙ্গীরা সঙ্গে সঙ্গে আরাফাতকে কম্বল দিয়ে পেঁচালেন। একের পর এক কম্বল পেঁচিয়ে তার শরীরের চারদিকে এমন আস্তরণ সৃষ্টি করা হল যাতে বিমানটি ভেঙ্গে পড়লেও আরাফাত বড় ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আগুন না লাগলে দুর্ঘটনার পরও যাতে বেঁচে যেতে পারেন। আরাফাতকে কম্বল পেঁচানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিমানটি লিবিয়ার এক মরু প্রান্তরে ভেঙ্গে পড়ে বালুর স্তুপে। ভেঙ্গে পড়ার আগেই বিমানটির তেলের ট্যাঙ্ক শূন্য হয়ে পড়ায় তাতে আগুন লাগেনি। আরাফাতের বিমানটি তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে লিবিয়া যাওয়ার পথে ঘটেছিল এ বিপত্তি। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে বিমানটির যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় মরুঝড়ে পড়ার পরপরই। সে সময় আমেরিকার সঙ্গে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পিএলওর সাপে-নেউলে সম্পর্ক। তা সত্ত্বেও এ বিপদের দিনে তারা আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ভাগ্যক্রমে তারা পিএলওর আবেদনে সাড়া দেয়। উপগ্রহ সিস্টেমের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে বিমানটি কোথায় ধ্বংস হয়েছে ঠিক সে তথ্যটি জানায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। লিবিয়ার এক দুর্গম মরু অঞ্চলে বিধ্বস্ত বিমানটির সন্ধান পাওয়া যায়। ধ্বংসস্ত‚প থেকে আরাফাতকে উদ্ধার করা হয় কম্বল পেঁচানো অবস্থায়। বিমানটির চালক ও যাত্রীদের কেউ বেঁচে না থাকলেও আরাফাত প্রাণে রক্ষা পান সহকর্মীদের আত্মত্যাগে। যদিও সামান্য আহতও হন তিনি। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তিচুক্তির পর আরাফাত স্বদেশে ফিরে আসার সুযোগ পান। তার আগে পিএলওর সদর দফতর ছিল তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে। আরাফাতের অবস্থানও ছিল সেখানে। অবিশ্বাস্য নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ছিল তার বসবাস। আরাফাত কোথায় আছেন সিনিয়র দু’একজন নেতা ছাড়া আর সবারই ছিল অজানা। তার গোপন আবাসস্থলে ব্যক্তিগত স্টাফ ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। কোন বিদেশীর জন্য সে গোপন অবস্থানে যাওয়ার ছিল অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
ফিলিস্তিনি জনগণের হৃদয়ের অধিশ্বর হিসেবে বিবেচিত হতেন ইয়াসির আরাফাত। মুসলিম- খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল ফিলিস্তিনির কাছে তিনি ছিলেন সমান প্রিয়। ফিলিস্তিনের বেথলেহামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্ট। যিশুর জন্মদিনের উৎসবে বেথলেহামের গির্জায় যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত তাতে প্রতিবারই প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতেন ইয়াসির আরাফাত। ইসরায়েলিরা মৃত্যুর আগের তিন বছর আরাফাতকে এ অনুষ্ঠানে যোগদানের অনুমতি দেয়নি। বেথলেহাম গির্জা কর্তৃপক্ষ আরাফাতের বদলে কাউকে এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করতে রাজি হয়নি। যে কারণে প্রধান অতিথির আসনে স্থান পেয়েছে আরাফাতের ঐতিহ্যবাহী আরবি স্কার্ফ। দৈহিকভাবে আরাফাতের উপস্থিতিতে বাধা সৃষ্টি করা গেলেও মানুষের হৃদয় রাজ্যে তার স্থান যে কোথায় ছিল এটি তার প্রমাণ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
ই-মেইল : [email protected]
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন