সম্প্রতি কালের কণ্ঠ পত্রিকায় দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা এই মুহূর্তে দেশের উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সাহস জোগাবে। গত ২০ নভেম্বর অর্থ উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ভালো ব্যবসায়ীদের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, যারা ঋণ নিয়ে ঠিকমতো ফেরত দেন এবং ঠিকমতো কর দেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে ব্যাংকিং খাতের প্রসঙ্গ উঠে এলে তিনি এ ব্যাপারেও খুবই স্পষ্ট করে বলেছেন যে, খেলাপি ঋণের চাপে নাজুক অবস্থায় আছে ১০টির বেশি ব্যাংক। তারপরও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না।
এই প্রসঙ্গে তিনি ব্যাংকের আমানতকারীদের আশ্বস্ত করে খুবই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ‘ব্যাংক বন্ধ না হওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করছি। আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।’
এই প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে উদ্ধৃত করে কালের কণ্ঠে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ হতে দেব না।’
এই প্রসঙ্গে পরিবর্তিত অবস্থার কারণে সংকটে পড়া দেশের দুটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তিনি আরো স্পষ্টভাবে বলেন যে দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় সম্পদ। ব্যক্তি থাকুক আর না থাকুক, প্রতিষ্ঠান থাকবে এবং চলবে। সেই আলোচনায় তিনি এমনও বলেছেন যে ‘এসব বড় শিল্প গ্রুপের সঙ্গে বহু মানুষের জীবিকা জড়িত। প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক কর্মচারী কর্মরত।
দেশের উৎপাদনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না, বরং এসব প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে আরো শক্তিশালী করা যায় সেই বিষয়েও কাজ করতে হবে।’ এমনকি তিনি আরো বলেছেন যে ‘ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দেশ ও জাতি উপকৃত হয়। আমরা ব্যর্থ হতে চাই না এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ হতে দেব না।’
আমরা অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে যেভাবে চিনি ও জানি তাতে, ওপরের কথাগুলো আসলেই তাদের মনের কথা।
অনেক দেরিতে হলেও দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের এই মুহূর্তের দুজন কাণ্ডারি যে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তাদের আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে এসব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, এ জন্য তাদের দুজনকেই অনেক ধন্যবাদ। এই মুহূর্তে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুজন ব্যক্তির এমন স্পষ্ট বক্তব্য ব্যবসায়ীদের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল, যদিও আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, শুধু মৌখিক আশ্বাসে খুব একটা কাজ হয় না। তা-ও আবার যদি সেই বক্তব্য কোনো সংবাদ সম্মেলন বা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় বলা হয়, তাহেল সেটি আরো কার্যকর হতে দেখা যায় না। কিন্তু বর্তমানে দেশের ব্যাংক, অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে মাত্রার অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে এবং খোদ ব্যবসায়ীরা যেভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছেন, সেখানে এই মৌখিক আশ্বাসের গুরুত্বও অনেক বেশি।
সরকার পরিবর্তনের পর থেকে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা এবং সমস্যার মধ্যে আছে। যেভাবে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে শুরুর দিকে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং কিছু অব্যবস্থা দেখা দেবে, তা সবার ধারণার মধ্যেই ছিল। কিন্তু এ রকম দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা দেখা দেবে, তেমনটা হয়তো কারো ভাবনার মধ্যেও ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে তিন মাস সময় অতিবাহিত হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ নেই। এমন পরিস্থিতি কেউ প্রত্যাশা করেনি। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা এবং অভিযোগের শেষ নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ঋণখেলাপি এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততাসহ অনেক অভিযোগের তীর তাদের দিকেই তাক করে রাখা হয়। এর কিছু সত্যতা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজ এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে না। তার পরও এ কথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে এই ব্যবসায়ীরাই দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন, দেশের পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেন এবং পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখেন। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে। বিশ্বের উন্নত দেশ তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও ব্যবসা করা একটি সহজ কাজ। সেখানে ব্যবসায়ীদের সব কিছুতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে ব্যবসা করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। সর্বক্ষেত্রে তাদের সমস্যা মোকাবেলা করে ব্যবসা এগিয়ে নিতে হয়। প্রশাসন থেকে কোনো রকম সহযোগিতা পাওয়া যায় না। পদে পদে বিশেষ সুবিধা দিয়ে কাজ আদায় করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় না। ঋণ পেলেও সুদের হার এত বেশি যে সেই সুদ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এর ওপর আছে চাঁদাবাজি।
এতসব প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়েও ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। সরকার পরিবর্তনের ফলে ঘটে গেল এক ছন্দঃপতন এবং নতুন করে দেখা দিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ব্যবসায়ীও আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী জেলেও গেছেন আবার অনেকে জেলে না গেলেও জেলে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এবং অনেকে এখনো আত্মগোপনে থাকছেন। অনেকে বিদেশে যেতে পারছেন না। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিককে দুর্নীতি দমন কমিশন তলব করে বা তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে এক নতুন আতঙ্কের মধ্যে ফেলা দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেকে ব্যাবসায়িক কাজে বা চিকিৎসার কারণেও দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। দেশের অর্থনীতির বৃহত্তম স্বার্থে এসব মোটেই ভালো লক্ষণ নয় এবং এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য।
যেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, নেই তারা যাতে আতঙ্কে বা ভয়ে না থাকেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন সবার আগে। এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আর দেরি না করে অতি সত্বর ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত এবং নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর শুরুটা হয়তো অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের বক্তব্যের মাধ্যমে হয়েছে। এখন এটি এগিয়ে নিতে হবে এবং বাস্তবে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। শুধু মুখের কথায় যেহেতু কাজ হয় না, তাই আমরা আশা করব অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর নিয়মিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবেন। সেই আলোচনায় অভিযুক্তরা ছাড়া দল-মতের ভিত্তিতে বিবেচনা না করে সব ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে খুব দ্রুতই ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরবে। আমাদের বিশ্বাস যে অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর দেশের ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে যে আশার কথা বলেছেন, তা শুধু কথার কথা হিসেবে বলেননি, বরং প্রকৃত অর্থেই বিষয়টি বুঝিয়েছেন এবং বাস্তবায়নের অভিপ্রায় নিয়ে বলেছেন। তাই এর বাস্তব প্রতিফলন ব্যবসায়ীদের মধ্যে শিগগিরই পড়বে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল যথেষ্ট আশাবাদী হয়েছিল, যখন দেশের দুজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। এই দুজন ব্যক্তি বাংলাদেশে খুবই পরিচিত মুখ এবং তারা দুজনই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রাব্যবস্থা এবং অর্থনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত আছেন। দেশের ব্যাংকিং খাত, মুদ্রাব্যবস্থা এবং অর্থনীতির বিরাজমান সমস্যা, সীমাবদ্ধতা, সুযোগ এবং স্কোপ—সব কিছুই তাদের নখদর্পণে। এসব সমস্যা এবং এর সমাধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে তারা দুজনই মিডিয়ায় নিয়মিত কথা বলেছেন এবং লিখেছেন। এ রকম ব্যক্তি যখন দেশের ব্যাংকিং খাত এবং অর্থনীতির দায়িত্ব পান, তখন ভালো কিছু হবে, এটিই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি। উল্টো প্রথম দিকে তাদের কিছু হতাশাজনক কথাবার্তা; যেমন—অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে, ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের দায়ী করা প্রভৃতি বক্তব্য ভালোর চেয়ে খারাপ করেছে বেশি। যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে বাস্তবতার আলোকে কথা বলেছেন, তাই এখন হয়তো দেশের ব্যাংকিং খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সংকট কাটতে শুরু করবে। এখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের মৌখিক আশ্বাস বাস্তবে প্রতিফলিত হলে এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করতে পারলে ব্যবসায়ীরা আরো বেশি নিশ্চিত এবং আশ্বস্ত হতে পারবেন। কারণ এই মুহূর্তে উচ্চ পর্যায় থেকে এ রকম আশ্বাস দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
[email protected]