লেবু বেশি চিপলে যেমন তেতো হয়ে যায়, তেমনি ‘সংস্কার’ শব্দটিকে কচলিয়ে তেতো বানানো হচ্ছে কিনা রাজনৈতিক অঙ্গনে সেই প্রশ্নটি ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস খুব স্পষ্ট ভাবেই সংস্কার প্রসঙ্গে তার অবস্থানও স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি বেশি সংস্কার চাওয়া হয় তাহলে জুনে নির্বাচন। আর যদি কম সংস্কার করা হয় তাহলে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ বিবিসি, স্কাই নিউজ সহ একাধিক দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে তিনি একথা বলেছেন। তিনি জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। সংস্কার কোন চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। যে সব বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেই সব সংস্কার করেই দেশ নির্বাচনের পথে হাটবে। বাকি সংস্কারের বিষয় ফয়সালা হবে নতুন জাতীয় সংসদে। কিন্তু এখন কিছু কিছু ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তারা প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন না। বরং একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা কাজ করছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ রাজনৈতিক দলগুলোর মত পার্থক্য ও বিভক্তি বাড়ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছে। এই বৈঠকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ার ড. আলী রিয়াজ। জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন কমিশন সংস্কারের যে প্রস্তাব করেছে রাজনৈতিক দলগুলো এই সব প্রস্তাবের ব্যাপারে তাদের মতামত দিচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যদি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুধাবন করে থাকেন তাহলে কমিশনের প্রধান কাজ হলো যে সব বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দল একমত, তার একটি সুনির্দিষ্ট লিপিবদ্ধ করা এবং এটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেয়া। প্রধান উপদেষ্টা যে বিষয়গুলোতে ঐক্যমত আছে সেই বিষয়গুলোর ভিত্তিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করবেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হবে নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন। ঐকমত্য কমিশন কোন দরকষাকষির প্রতিষ্ঠান নয়। ওই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকে কোন সংস্কারের যুক্তি, তর্ক করার প্রবণতা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক গুলো যেন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কমিশনের সদদ্যদের বিতর্কের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। ‘সম্ভাবনার’ জায়গাটিকে ‘সম্ভব না’ এর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। এটা কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়। এর ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন উসকে দেওয়া হচ্ছে। একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
আমরা লক্ষ্য করছি, কিছু কিছু সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট ঐক্যের বদলে জাতিকে বিভক্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে। নারী সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে দেশে বিভক্তি এবং অনৈক্যের সূত্রপাত করেছে। যেমন- নারী সংস্কার কমিশনের কথা বলতেই হয়। এই কমিশনের রিপোর্টটি মোটেই আমল যোগ্য নয়। এটি ধর্মপ্রাণ মানুষের চেতনায় আঘাত করেছে। এর সঙ্গে আপামর জনসাধারণের সংস্রব নেই। সাধারণ মানুষ এবং প্রতিনিধিত্বশীল নারী সমাজের মতামত ছাড়াই এই সংস্কার কমিশন রিপোর্ট তৈরি করেছেন কিছু এনজিও ভিত্তিক নারী উন্নয়ন কর্মী। কাজেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টকে আলাদা করে রাখতে হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্টটিও অগ্রহণযোগ্য, বিতর্কিত এবং একপেশে হিসেবে দেখছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। আমি মনে করি, শুধু দুটি কমিশনের রিপোর্ট নির্বাচনের আগে আলোচনা হওয়া উচিত। বাকিগুলো নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। যে দুটি কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হতে পারে তার মধ্যে একটি হলো সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট। দ্বিতীয়টি হলো নির্বাচন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট। বাকি যে সংস্কার কমিশন গুলো সুপারিশ তৈরি করেছে তা নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। কারণ এই সমস্ত সংস্কারগুলো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এখানে জনমতকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনমতের সম্মতি ছাড়া এই সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে।
ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি যে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের বিভাজন দেখা দিয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য পেশাজীবী ক্যাডারগুলো রীতিমতো মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি নির্মোহ ভাবে পুরো সংস্কার আকাঙ্ক্ষাকে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব আমাদের প্রথম দরকার একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এমন একটি ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া যে ব্যবস্থায় নতুন কোন স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে না। ২০১৪ বা ২০১৮ এর মতো নির্বাচন করার কথা কোন ক্ষমতাসীন দল চিন্তাও করতে পারে না। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের মধ্যে অন্যতম হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে কারও কোন আপত্তি আছে বলে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের আরও কিছু বিষয় আছে যে বিষয়গুলো নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত। কিন্তু নির্বাচন সংস্কার কমিশন কতগুলো সুপারিশ করেছে যে সুপারিশগুলো শুধু অবাস্তব নয়, এটি আমলযোগ্যও নয়। যেমন নির্বাচন সংস্কার কমিশন বলেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলেই তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এটি একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা। কারণ এটি পরবর্তীতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি যদি নির্বাচনী আইনে সংযুক্ত হয় তাহলে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যে একজন অন্য প্রতিপক্ষকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বাধা দেওয়ার জন্য এই ধরণের অভিযোগ দায়ের করবে। তাছাড়া এই সুপারিশটি আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী। কারণ আমাদের সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। আইনের সাধারণ সূত্র হলো একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্ত রায়ে দণ্ডিত না হন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলে ধরে নিতে হবে। কাজেই আইনের শাসনের মূল চেতনার পরিপন্থী এ রকম কিছু বিষয়কে অযৌক্তিক ভাবে যুক্ত করা ঠিক নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরও কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে। এই বিতর্কে আমরা যেতে চাই না।
আমরা ঐকমত্যের জায়গায় যেতে চাই। নির্বাচন কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলোতে সকল রাজনৈতিক দল একমত সেই বিষয়গুলোকে নিয়ে এগোনো উচিত। যেকোন একটি জিনিসকে দু ভাবে দেখা যায়। ইতিবাচকভাবে অথবা নেতিবাচকভাবে। একটি গ্লাসে অর্ধেক পানি আছে- এটিকে কেউ বলতে পারেন অর্ধেক খালি। আবার কেউ বলতে পারেন অর্ধেক ক্লাস পূর্ণ। আমরা সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব। বিভাজন নিয়ে নয়। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে তাদের সুপারিশগুলো যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটির কোন প্রয়োজন আছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে না। কোন সংস্কারই চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। তাছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোন সংস্কারই শেষ পর্যন্ত সম্ভব না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে তারা ১৪১ টি সুপারিশের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। আংশিক একমত হয়েছেন ১৪ টিতে। মন্তব্যসহ ভিন্ন মত দিয়েছেন ৬৪ তে। একমত নন ২৪ টিতে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ সুপারিশের ব্যাপারে তারা একমত। কাজেই যে বিষয়গুলোতে সব রাজনৈতিক দল একমত সেগুলো নিয়ে সামনে এগুনো যায়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। সংবিধান সংস্কার এই সরকারের এখতিয়ার নাই। জাতীয় সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কারও নেই। তারা কিছু সুপারিশ রাখতে পারে। এটির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত হতে পারে। সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। যেমন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন আপত্তি নেই। পরপর দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন আপত্তি নেই। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে পরপর দুইবারের পর বিরতি দিয়ে আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে দাঁড়াতে পারেন। এটি তাদের মতামত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যখন সংবিধান সংশোধন করা হবে, তখনকার এই বিষয়টি তুলে রাখা যেতে পারে। কিন্তু মৌলিক বিষয় হলো পরপর দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। সংবিধান সংস্কারে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার যে সুপারিশ করা হয়েছে, তার কিছু কিছু বিষয়ের সঙ্গে বিএনপি একমত। কিন্তু অনেক বিষয়ের সঙ্গে তারা একমত নন। একই ভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যে ধরনের ক্ষমতা তাকে দেওয়ার জন্য আইন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে বিএনপি এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয় বলে তারা জানিয়েছে।
অন্যদিকে সংসদ এবং রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর এবং দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করা জরুরি, জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাব বিধান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, মৌলিক স্বাধীনতার নামে আলাদা আলাদা অন্তর্ভুক্ত করা, সংবিধানে দেশের নাম পরিবর্তন, নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য ২১ বছর করার মতো প্রস্তাব গুলোতে বিএনপি একমত হয়নি। আবার এই কমিশনের অনেক সুপারিশে একমত হয়েছে বিএনপি। যেমন বিদ্যমান সংবিধানে থাকা ৭ (ক) বিলুপ্ত করা। সংসদ দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট করা, উভয় কক্ষে দু জন ডেপুটি স্পিকারের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে নেওয়া, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন পদ্ধতি, অর্ধস্তন আদালতের বদলে স্থানীয় আদালত শব্দ ব্যবহার করা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য অনুর্ধ্ব ১৫ জন রাখা, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার মতো স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিএনপি সহ সকল রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। আর সে কারণে সকলেই মনে করে আমাদেরকে ঐক্যের পথ খুঁজতে হবে, বিভক্তির নয়। গত পুরো সপ্তাহ জুড়ে কমিশন যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করেছে, সেই বৈঠক গুলোকে বিভাজনগুলোই উঠে এসেছে। তাই যেসব সুপারিশ সকল পক্ষ একমত তার ভিত্তিতে দ্রুত সর্বদলীয় বৈঠক করে জুলাই ঘোষণার সনদ তৈরি করা যেতে পারে। এর ফলে সকল অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশ নির্বাচনের পথে হাটতে পারে। কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলকে কোন বিষয় জোর করে বাধ্য করা বা কোন সংস্কারে জোর করে রাজী করানো হলে বিভক্তি, বিভাজন বাড়বে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে যত দীর্ঘ আলোচনা চলবে তত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে এই অনৈক্যের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তা যেন না ঝড়ে রূপ নেয় সেদিকে নজর রাখতে হবে এখনই। ঐকমত্য কমিশন যেন বিভাজন কমিশন না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল: [email protected]