আগস্ট মাসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সরকারি সফরে মালয়েশিয়া যাবেন। এটি একটি দ্বিপক্ষীয় সফর হবে। মূলত জুলাই মাসেই তাঁর মালয়েশিয়া সফরে যাওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সে সময় তাঁর নানা ব্যস্ততা থাকবে বিধায় সফরটি আগস্ট মাসে আয়োজন করা হয়। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব বিষয় উত্থাপন করা হবে, সেগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণ এবং সে দেশে কর্মরত আমাদের অভিবাসীদের সমস্যাদি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে মনে করি।
জানা মতে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকার এবং সে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার যে উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে, দুই দেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে সেই সুযোগটি অবশ্যই কাজে আসবে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথাবার্তা হবে। সেসব বিষয়ের মধ্যে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ এবং সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের কল্যাণ।
আগে বিচ্ছিন্নভাবে গেলেও ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের যাওয়া শুরু হয়। কিন্তু নিয়োগপ্রক্রিয়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের কর্মীদের শোষণ, প্রতারণা ও বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব কারণ দেখিয়ে মালয়েশিয়া সরকার বেশ কয়েকবারই (১৯৯৬, ২০০১, ২০০৯, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে) বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মূল কারণগুলো ছিল বাংলাদেশি কর্মীদের উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, নিয়োগকারীদের কর্মসংস্থানের সামর্থ্যের অতিরিক্ত সংখ্যায় কর্মী নেওয়া এবং অবৈধভাবে অবস্থান করা বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি।
এসব মাথায় রেখে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে দুই দেশের মধ্যে ‘জিটুজি’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ওই প্রক্রিয়ায় একজন কর্মীর অভিবাসন ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার টাকারও কম। কিন্তু ওই পদ্ধতিতে এজেন্সিগুলোর সম্পৃক্ততা না থাকায় মাত্র ১০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরপরই স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপে প্রক্রিয়াটির অপমৃত্যু ঘটে। ২০১৬ সালে ‘জিটুজি প্লাস’ নামের একটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে মাত্র ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেটকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে মালয়েশিয়ায় সরকারের পরিবর্তন হলে আমাদের কর্মী নিয়োগে আবার নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। যা হোক, ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের পরিবর্তে ২৫টি এজেন্সির, যা পরে ১০০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটে পরিণত হয়।
জানা মতে, ১০০ এজেন্সির সিন্ডিকেট ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক চার লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জন কর্মীর ছাড়পত্র পেলেও ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মী নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় যেতে পারেননি। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জুন মাসে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এদিকে ওই বছরের ৪ অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত সফরকালে যেতে না-পারা কর্মীদের বিষয়টি উত্থাপন করা হলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মত প্রকাশ করেন। ওই কর্মীদের নিয়ে নাটকের সমাপ্তি বোধ হয় এখনো হয়নি।
গত মে মাসে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ব্যাপারে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য মালয়েশিয়া সফর করে। দুই পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়- মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং আরো স্বচ্ছ ও নৈতিক নিয়োগ কাঠামোর আওতায় নতুনভাবে কর্মী নিয়োগের একটি প্রক্রিয়ার রূপরেখা তৈরি করা।
ওই সফরের ধারাবাহিকতায় মে মাসেই ঢাকায় মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া শুরু করলে কী প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন করা হবে, অর্থাৎ আগের মতো কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট, নাকি বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী প্রেরণের সুযোগ পাবে, সে বিষয়টিও আলোচিত হয়।
দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই দুটি আলোচনা যদিও আমাদের মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী কর্মীদের আশার আলো দেখাচ্ছে, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণ করা হবে তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। যদি সেই প্রক্রিয়াটি কর্মীবান্ধব না হয় এবং অভিবাসী কর্মী হিসেবে প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে সে ধরনের পদ্ধতি গ্রহণের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। একটি শোষণহীন, নিরাপদ ও কর্মীবান্ধব নিয়োগ পদ্ধতি যাতে বাস্তবায়ন করা যায়, যেখানে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর স্বার্থও রক্ষিত হয়, সে বিষয়ে উভয় পক্ষকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা কখনোই ভালো ছিল না। কখনো সিন্ডিকেট, কখনো উভয় দিকের কিছু লোভী চক্র বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং ফল হিসেবে নিষেধাজ্ঞা নেমে এসেছে। মাঝখানে ওইসব কর্মীর পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা গিয়ে জমা পড়েছে সিন্ডিকেটের বা চক্রের লোকজনের পকেটে। যেমন- ২০২১ সালের সমঝোতা অনুযায়ী কর্মীপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও একজন কর্মীকে সাড়ে চার থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। ব্যয় নির্ধারণ করে দিলেই সরকারের দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায় না, যথাযথ মনিটর করতে হয়। সেটি কখনো করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
তবে অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। সেটি ২০১২ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত জিটুজি পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপে দুই বছরের মাথায় মাত্র ৩৫ হাজার টাকা অভিবাসন ব্যয়ের ওই পদ্ধতির অকালমৃত্যু ঘটে। এরপর আবার বাংলাদেশের কর্মীদের জীবন চলে যায় সিন্ডিকেটের হাতে। তাহলে কি আমাদের কর্মীদের ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ করে একটি গ্রহণযোগ্য অভিবাসীবান্ধব নিয়োগপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যাবে না? কিভাবে কর্মীবান্ধব নিয়োগ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে বর্তমান সরকারকে কাজ করতে হবে।
আসলে এ ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক উন্নতি ঘটাতে হলে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ উভয় প্রান্তেই স্বার্থান্বেষী মহলের জাল পাতা রয়েছে। ওই জাল পাতার যেন আর সুযোগ না পায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণই একমাত্র পথ। দুই দেশের সরকার যদি কর্মীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তাহলেই কর্মীবান্ধব নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা সম্ভব। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করে ২০১২ সালের জিটুজি পদ্ধতির অনুসরণে (ন্যূনতম অভিবাসন ব্যয়ে) একটি পদ্ধতির সমঝোতা করা গেলে সবার জন্যই মঙ্গল। আর সেটিই হতে পারে এ ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য স্থায়ী প্রক্রিয়া।
আমরা আশাবাদী, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন মালয়েশিয়া সফরে সেই সুখবরটা আমাদের মালয়েশিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের আমরা দিতে পারব। তবে এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে তার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হবে। শুধু বক্তৃতায় যতই রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলা হোক না কেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর এটিই হতে পারে সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ