বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অটিজম সম্পর্কিত শুভেচ্ছা দূত সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বলেছেন, “অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে সফল, ক্ষমতায়িত ও কর্মক্ষম ব্যক্তিতে পরিণত করতে আমাদেরকে সমন্বিত ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হবে।”
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে ৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকালে ইকোসক চেম্বারে ‘অটিজম আক্রান্ত নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক আলোচনায় সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি এ আহবান জানিয়েছেন।
এসময় তিনি ‘অ্যবলিজম, সেক্সিজম, রেসিজম...হাউ দে ইন্টারসেক্ট’ বিষয়ে আলোকপাতকালে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের যে সকল সামাজিক ও পারিবারিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এছাড়া অটিজমের শিকার নারীদের বিভিন্ন বৈষম্য ও তাঁদের প্রতি গতানুগতিক সামাজিক ও পারিবারিক ধারণার কথা, তাদের নাজুক পরিস্থিতি এবং পরিবারের সদস্যসহ আশে-পাশের মানুষের দ্বারা নিগ্রহ ও নির্যাতনের বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন পুতুল।
বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অটিজম শিশুদের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা আশাব্যঞ্জকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশে জাতীয়, আঞ্চলিক, উপজেলা পর্যায়ের সকল অনুষ্ঠানে অটিজম আক্রান্তদের প্রসঙ্গ উঠছে এবং তারাও অগ্রসরমান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে উল্লেখ করে পুতুল বলেন, অটিজম আক্রান্ত নারী ও মেয়েরা নানবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে নিজেদের একান্ত চাওয়া পাওয়ার কথাও ঠিকমতো বোঝাতে পারেন না। এসকল নারীদের বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনসহ প্রাত্যহিক জীবন-যাপন বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবহারিক শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
পাশাপাশি তারা যাতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে পারে সে ব্যাপারেও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, ‘অটিজম আক্রান্তদের সমাজে জায়গা করে দিতে হবে, যাতে তারা তাদের অবদান রাখতে পারে। অন্যথায় সমাজে বড় ধরণের বিভেদ তৈরি হবে।’
‘জাতিসংঘের কমিটি অন দ্যা রাইট অব পারসন উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি’র মেম্বার প্রফেসর জোনাস রুজকুস'র এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের অটিজম বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বলেন, ‘কনভেনশন অন দ্যা রাইট অব পারসন উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি-এর সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আন্ত:মন্ত্রণালয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এর ফলে এক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দূত হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আরও জানান, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের কল্যাণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের সহযোগিতায় আঞ্চলিক সমন্বিত কাঠামো গঠন করা হয়েছে যা সরকার ও বেসরকারি সংস্থার সাথে একযোগে কাজ করে।
এ আলোচনায় প্যানেলিস্টদের মধ্যে আরো ছিলেন অটিজম উইমেন নেটওয়ার্কের চেয়ারপারসন মরেনিকি গিওয়া- ওনাইয়ু, অটিজম কনসালট্যান্ট অ্যামি গ্রাভিনো।
শতাধিক দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, অটিজম নিয়ে বিশ্বব্যাপী কর্মরত সংগঠক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ছাড়াও ফ্লোরে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা। মডারেটর ছিলেন জাতিসংঘের এনজিও সম্পর্ক বিষয়ক অফিসের প্রধান জেফ্রি ব্রিজ।
এ আলোচনার পর অনেকেই সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের কাছে এসে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান অটিজম আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক সচেতনতা তৈরীর ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনের জন্য। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সামাজিক-বাস্তবতার মধ্যেও অটিজম আক্রান্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে নানা কর্মসূচি গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অটিজম ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ করতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের অবদানের কথা সকলে উল্লেখ করেন।
এ উপলক্ষে জাতিসংঘ সদর দফতরের গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি প্রদর্শণীর উদ্বোধনকালে তাঁর প্রতিষ্ঠান সূচনা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট ও এনজিওদের সাথে সমন্বিতভাবে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডারসহ অন্যান্য ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের কল্যাণে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সায়মা ওয়াজেদ। তিনি বলেন, “সকলেরই সমাজে সমানভাবে এবং সম্মানের সাথে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। অটিজম আক্রান্তদের বিশেষ করে মেয়ে ও নারীদের সব ধরণের সুযোগ দিতে হবে যা তাদের প্রয়োজন”।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ ও কাতার মিশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। অটিজম নিয়ে কাজ করছে এমন সংস্থাসমূহ এ প্রদর্শণীতে অংশ নেয়। প্রদর্শনীটির সহ আয়োজক ছিল জাতিসংঘে ভারত, কুয়েত ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্থায়ী মিশন এবং অটিজম বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘অটিজম স্পীকস্।’
প্রদর্শণীতে বিভিন্ন সদস্য দেশ, জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা যেমন ইউনিসেফ ও বিভিন্ন এনজিও স্টল স্থাপন করে। সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের প্রতিষ্ঠান ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ এই প্রদর্শণীতে অংশ নেয় যা দর্শকদের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করে।
প্রদর্শণীতে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার গত ৯ বছরে অটিজম ও অন্যান্য নিউরোডেভোলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের কল্যাণে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে মর্মে উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “এজেন্ডা ২০৩০ গ্রহণকালে আমরা ‘কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না’, বিশেষ করে যারা অসহায়- মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। অটিজম ও অন্যান্য নিউরোডেভোলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ যাতে অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে উন্নত জীবন যাপন করতে পারে তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা প্রতিবছর অটিজম সচেতনতা দিবস পালনের মাধ্যমে আমাদের সেই প্রতিশ্রুতি পূনর্ব্যক্ত করছি”।
প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে অন্যান্যদের মাঝে আরও বক্তব্য দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত কুয়েত ও কাতারের প্রতিনিধিরা।
বিডি প্রতিদিন/৬ এপ্রিল ২০১৮/হিমেল