ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের জেরে ভারতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। এর মধ্যে উড়িষ্যায় এক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, পশ্চিমবঙ্গের মৃত্যু হয়েছে দুই জনের।
ভারতে প্রথম মৃত্যু হয় ওড়িশার ভদ্রক জেলায়। সেখানে ঘরের দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যু হয় এক দুই মাসের শিশুর।
মঙ্গলবার রাতে ভদ্রক একটি তিহিদি ব্লকের কান্নাডা গ্রামের নিজের বাড়ির নিজেদের বাড়িতে ঘুমাচ্ছিল
কৃষক বলরাম দাসের ছেলে। সারারাত ধরে বর্ষণের কারণে বুধবার সকালে মাটির দেয়াল ভেঙে পড়ে। আর তাতেই চাপা পরে মৃত্যু হয় ওই শিশুর।
আম্ফান এর প্রভাবে বুধবার ভোররাত থেকেই ভদ্রক, কেন্দ্রপাড়া, কটক, পুরী, গঞ্জাম, জয়পুর, বালাসোর-এর মতো ওড়িশার উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে প্রবল বৃষ্টি ও ঝড় শুরু হয়। রাজ্যটির পারাদ্বীপ বন্দরে সবথেকে ভয়ঙ্কর রূপ ছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের। সেখানে ঝড়ের গতি বেগ সকালের দিকে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। ঝড়ের দাপটে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। ভেঙে পড়ে বহু গাছ। ভেঙে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি।
এদিকে, আম্ফানের কারণে পশ্চিমবঙ্গে দুই জনের মৃত্যু হয়। দুপুরের দিকে টিনের চালের আঘাতে হাওড়ায় ১৩ বছরের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। বিকেলে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মিনাখাঁয় ৫৬ বছর বয়সী নুরজাহান বেহরার মৃত্যু হয় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে।
তবে প্রাণহানি না হলেও কার্যত ধ্বংসের মুখে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা নামখানা ও বকখালি। নবান্ন সূত্রে খবর উপকূলের এই অঞ্চলগুলোতে সব থেকে বেশি কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়া এবং গাছ উপড়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিন দুপুরে স্থলভাগে ঢোকা শুরু করে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। বেলা আড়াইটে নাগাদ আম্ফানের ল্যান্ডফল প্রক্রিয়া শুরু হয় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দীঘা এবং বাংলাদেশের হাতিয়া দ্বীপের মধ্যবর্তী এলাকায়। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের বেশি। এরপর টানা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালায়। এর ফলে এই সমস্ত এলাকায় প্রবল বেগে ঝড়ো হাওয়া, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। সময় যত কাটে বৃষ্টি ও হাওয়ার তীব্রতা ততই বাড়তে থাকে।
ঝড়ের দাপটে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে গাছ। এর ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সড়ক যোগাযোগ। যদিও দুর্যোগের মধ্যেই অনেক জায়গায় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা উপরে পড়া বা ভেঙে পড়া গাছ সরানোর কাজে নেমে পড়েন। বহু জায়গায় ঘরের চাল উড়ে গেছে। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের দাপটে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দীঘায় পড়ে যায় টিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী দোকান। বুধবার দুপুরে একটি হোটেলের ভিতরে অবস্থিত দোকানটি খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। তবে দোকানটির ভিতরে কেউ না থাকায় কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ঝড়ের দাপটে দিঘা রেল স্টেশনের টিনের চাল উড়ে যায়।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে কলকাতা ও শহরতলি এলাকায়। একাধিক জায়গায় ভেঙে পড়েছে গাছ, সিগন্যাল পোস্ট, বিদ্যুতের খুঁটি। ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় বুধবার সকালেই কলকাতার বিভিন্ন বাজার গুলি বন্ধ করে দেয় পুলিশ। বিভিন্ন বাজারে গিয়ে মাইকিং করে বন্ধ করে দেয়া হয় ওইসব দোকানগুলি। বিপর্যয়ের কারণে একই সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কলকাতার সমস্ত উড়ালপুল। কলকাতায় অবস্থিত বিপদজনক বাড়িগুলি থেকেও বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদিও তারই মধ্যে কলকাতার পশ্চিম পুটিয়ারিতে পুরনো একটি বাড়ির একতলার কার্নিশ ভেঙে পরে। যদিও তাতে ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে বড় বড় হোডিং, সাইনবোর্ড।
আম্ফানের জেরে বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাত পাঁচটা পর্যন্ত কলকাতা বিমানবন্দরের সব কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে "সমস্ত পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস এর জেরে বিদেশে আটকে পড়া মানুষদের দেশে ফেরাতে কয়েকটি বিশেষ বিমান এর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেই সব আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হচ্ছে"।
এদিকে, রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নে কন্ট্রোল রুমে বসে রাজ্যের সমস্ত জেলার গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
কলকাতা পৌরসভার তরফ থেকে আলাদা করে কন্ট্রোলরুম খুলে সর্বক্ষণ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। দুপুরের পর থেকে গোটা বিষয়ে মনিটর করেন কলকাতার বিদায়ী মেয়র ও পৌর-নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
আম্ফান মোকাবেলায় কন্ট্রোলরুম খুলেছে কলকাতা পুলিশ। কলকাতা অবস্থানরত যেকোন বিপদে পড়লে সেই ফোন নাম্বারে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারেন।
আম্ফান নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ তথা অভিনেতা দীপক অধিকারী (দেব)। টুইট করে তিনি লেখেন "শক্তিশালী থাকো, সাবধানে থাকো! পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বাংলাদেশ।"
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন